হস্তান্তরের আগেই ঝুঁকিতে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বাঁধ
আতঙ্কে এলাকাবাসী
আবু-হানিফ, শরণখোলা প্রতিনিধি ঃ
বাগেরহাটের শরণখোলায় হস্তান্তরের আগেই ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত টেকসই বেড়িবাঁধ। বুধবার (১১ মে) বিকেলে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা পয়েন্টে বাঁধের ভেতর পাশে ফাঁটল দেখতে পান স্থানীয়রা। একই এলাকায় বাঁধের অপর পাশে শুরু হয়েছে বলেশ্বর নদের ভয়াবহ ভাঙন। উত্তর সাউথখালী গ্রামের বাবলাতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গাবতলা আশার আলো মসজিদ পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বাঁধের ব্লক ধসে গেছে। অনেক স্থানের ব্লক সরে গিয়ে জিও ব্যাগ বেরিয়ে গেছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বাঁেধর নিকটবর্তী বাসিন্দারা। তাছাড়া কাজ শেষ না হতেই ফাঁটল ও ভাঙন শুরু হওয়ায় বাঁধের স্থায়ীত্ব নিয়েও শঙ্কিত এলাকাবাসী।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় শরণখোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধ। এর পর টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি-১) নামে একটি মেগা প্রকল্প গ্রহন করে সরকার। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি ৬২ কিলোমিটার বাঁধের টেকসই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এই বাঁধ নির্মানের কাজ বাস্তবায়ন করছে ‘সিএইচডব্লিউই’ নামে একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে কাজের প্রায় ৯৫ ভাগ শেষ হয়েছে। জুন মাসে পানি উন্নন বোর্ডের কাছে বাঁধ হস্তান্তর করা হবে বলে সিইআইপি-১ সূত্র জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১২ মে) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাঁধের ভিতর পাশে ২০ ফুট এলাকাজুড়ে ফাঁটল ধরেছে। সেখানে মাটি দিয়ে কোনোমতে মেরামত করা হয়েছে। বাঁধের একেবারে গোড়া থেকে মাটি কেটে সেই মাটিই আবার বাঁধে দেওয়া হয়েছে। অশনির প্রভাবে বৃষ্টি হওয়ায় গোড়ার মাটি সরে গিয়ে এই ফাঁটলের সৃষ্টি হয়। ভারি বৃষ্টিপাত হলে বড় ধরণের ধসের আশঙ্কা রয়েছে সেখানে। ফাঁটলের ঠিক বিপিরিত পাশে বলেশ্বর নদের ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন বাঁধের সিসি ব্লকের কাছাকাছি চলে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বলেশ্বর নদের তীরের সাউথাখালী ইউনিয়নের গাবতলা, বগী, রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজেশ্বর, চাল রায়েন্দা এবং খোন্তাকাটা ইউনিয়নের শেষ সীমানার কুমারখালী ও ফাসিয়াতলা এলাকা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও ভাঙনপ্রবন স্থান হিসেবে চিহ্নিত। এসব এলাকায় নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মূল বেড়িবাঁধের ভেতরে বালু দিয়ে ভরাট করে তার ওপরে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের সকল স্তরেই দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। বাঁধ এখনো হস্তান্তর হয়নি। অথচ বর্তমান অবস্থা দেখলে মনে হবে যেনো এই বাঁধের বয়স ১০-১৫ বছর হয়েছে। কাজের মান খুবই নি¤œমানের হয়েছে। বাঁধের সবখানেই অনিয়মের ছাপ পড়ে আছে।
গাবতলা গ্রামের বাসিন্দা মো. জহির খান বলেন, বুধবার রাত ১০টার দিকে আমার চার থেকে পাঁচ কাঠা জমির গাছপালাসহ নদীতে তলিয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে নারকেল, সুপারি, আম, রেইনট্রি , চাম্বলসহ ২০-২৫টি গাছ প্রায় এক বিঘা জমি বিলিন হয়েছে।
বাঁধসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা হামেদ সরদার (৫৮), আববাস বয়াতী (৪৫), আলমগীর কান (৩০) বলেন, শুধু নামেই টেকসই বাঁধ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এটি বালির বাঁধ। ভেতরে বালি দিয়ে উপরে মাটি তার ওপর ব্লক বসানো হয়েছে। যে কারণে সামান্য বৃষ্টির পানি ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে ফাঁটল ও ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো রকম ভাঙন শুরু হলে এই বাঁধ টিকবে না। দ্রুত নদী শাসন করা না হলে বর্ষা মৌসুমেই মূল বাঁধে ভাঙন আঘাত করবে। তখন এই বাঁধ কোনো কাজে আসবে না। বাঁধের যে অবস্থা তাতে আমরা চরম আতঙ্কে আছি। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জাকির হোসেন হাওলাদার বলেন, গাবতলা এলাকার বাঁধের ফাঁটল দেখে মানুষ ভয়ে আছে। তাছাড়া, নদী ভাঙন বাঁধের কাছাছি চলে আসায় আমরা বাঁধের স্থায়ীত্ব নিয়ে শঙ্কিত। দু-এক মাসের মধ্যে মূল বাঁধে ভাঙন দেখা দেবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দ্রুত নদী শাসনের দাবি জানাই।
সাউধখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকায় সিডরে সাউথালীতেই প্রায় ৮০০ মানুষ মারা গেছে। এতোগুলো মানুষের জীবনের বিনিময়ে পাওয়া সেই বাঁধ এখন আবার ঝুঁকিতে। কাজের সর্বস্তরেই অনিয়ম হয়েছে। কাঝের শুরু থেকেই আমরা নদী শাসনের কথা প্রশাসন ও চায়না ঠিকাদার কম্পানিকে বলেছি বলা হলেও কোনো কাজ হয়নি। চায়না ঠিকাদাররা কারো কথায় গুরুত্ব দেয় না। তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করায় আজ টেকসই বাঁধ নিয়ে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। নদী শাসন না হলে এই বালির বাঁধ কোনোভাবেই রক্ষা করা যাবে না।
সিইআইপি-১ এর সাইড ইঞ্জিনিয়ার মো. রাকিবুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সম্ভবতঃ ইঁদুরের গর্ত থেকে বৃষ্টির পানি ঢুকে সামান্য ফাঁটল দেখা দেয়। ফাঁটল স্থানটি মেরামত করা হয়েছে। বিষয়টি আমদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নূর-ই আলম সিদ্দিকী বলেন, বাঁধের ফাঁটল এবং নদীর ভাঙনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত সমাধানের জন্য বলা হয়েছে।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) খুলনা অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নদী শাসনের ব্যাপারে আগেই প্রস্তাবনা পাঠানো আছে। প্রকল্প পাস হলে কাজ শুরু হবে। এছাড়া, প্রকল্পের কাজ জুনে শেষ হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাছে কাঝ হস্তান্তরের আগেই বাঁধের যেসব ত্রুটি আছে, সেগুলো মেরামত করা হবে।