স্থানীয় সংবাদ

অর্থোপেডিক্স বিভাগে একটি ইউনিট হওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি চরমে

(খুমেক হাসপাতালে অনিয়ম-অবহেলা চরমে , দেখার কেউ নেই-৬)

অপারেশনের সিরিয়াল পড়ে গড়ে ১২-১৬ সপ্তাহ পর, দালালরা এ সুযোগে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন রোগীদের, অপারেশনের রোগীদের জিম্মি করে টাকা আদায়

কামরুল হোসেন মনি ঃ খুলনা মেডিকেল কলেজ ( খুমেক) হাসপাতালে অর্থোপেডিক্স ও ট্রমাটোলজি বিভাগ মানে সহজ বাংলায় হাড়ের চিকিৎসা যেখানে হয়। এই হাসপাতাল এ অঞ্চলের ১৩ জেলার মানুষের হাড়ের বিভিন্ন চিকিৎসার বিশ্বস্ত একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর অনেক বছর পার হলেও এ বিভাগটি কাঙ্খিত সেবা প্রদান করতে পারছে না। এই হাসপাতালে নবনির্মিত ব্লকে সুপরিসর জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও ইউনিট না বাড়ানোর ফলে সেবা সংকুচিত হওয়ায় রোগীদের ভোগান্তি আগের তুলনায় বড়েছে। যেহেতু শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালে উক্ত বিভাগ থাকলেও জরুরী ভর্তির ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের পুরো চাপটাই থাকে খুমেক হাসপাতালে। খুমেক হাসপাতাল সূত্র মতে, নবনির্মিত ব্লকে সুপরিসর জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর অনেকদিন পার হয়ে গেলেও, ২ টি ইউনিটে বিভক্ত না হয়ে একটি মাত্র ইউনিটে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ওয়ার্ডে মহিলা ও পুরুষ মিলে মোট বেড সংখ্যা ৫০টি। এর মধ্যে পুরুষ বেড ২৬টি ও মহিলা বেড রয়েছে ২৪। এছাড়া অতিরিক্ত বেড রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে অকেজো(ভাঙ্গা) ৫টি। এছাড়া পেইং বেড আছে ১০টি। গতকাল শনিবার ( ১০ ফেব্রুয়ারি) অর্থপেডিক্স বিভাগে ভর্তি ছিলো ১২৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ছিলো ৭৮ জন এবং মহিলা ছিলো ৫০ জন। প্রতি সপ্তাহে এখানে একবার মাত্র ওটি হয়। প্রতি সপ্তাহে সিরিয়াল অনুযায়ী ১৩-১৪ জন রোগী ওটিতে নেওয়া হয়। এর মধ্যে ওটি হয় ৭-৮ জনের। অপারেশনের সিরিয়াল পেতে ভর্তি রোগীদের ২-৩ মাসও লেগে যায়। ২০২৩ সালের ওই ওয়ার্ডে মোট রাগীর চিকিৎসা করা হয় ১৪ হাজার ৯১০ জন। এর মধ্যে পুলিশ কেস রোগীর সংখ্যা রয়েছে ২ হাজার একজন।
খুমেক হাসপাতালের সূত্র মতে, এই হাসপাতালের অনান্য বিভাগসমূহ রোগীদের সেবা প্রদান সহজীকরণ ও সেবা সম্প্রসারণ এর কথা মাথায় রেখে ২ বা ততোধিক ইউনিটে বিভক্ত হয়ে সেবা প্রদান করলেও অর্থোপেডিক্স বিভাগ একটি মাত্র ইউনিটে সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে এ অঞ্চলের সেবা প্রত্যাশ্যী রোগীরা তীব্র ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। সাধারণ যেকোনো অপারেশনের জন্য ক্ষেত্রবিশেষ অপেক্ষার প্রহর ঠেকছে নূন্যতম গড়ে ১২-১৬ সপ্তাহ বা তারও বেশি। ভর্তিকৃত রোগীদের বড় এক অংশ বাইরের বিভিন্ন ক্লিনিক বা বেসরকারি হাসপাতালে দালালের সহায়তায় ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই বিভাগেরই কিছু চিকিৎসক যার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অসহায় রোগীরা। এ ছাড়া বিভিন্ন অপারেশনে প্রয়োজনীয় সার্জিক্যাল ইমপ্ল্যান্ট/ স্ক্রু-প্লেট কেনার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে এ বিভাগের কিছু চিকিৎসকের প্রত্যক্ষ মদদে ও সিনিয়র কয়েকজন চিকিৎসকের ইশারায়। মেডিকেল ও সার্জিক্যাল ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে কোন রোগীই বাজার থেকে কাঙ্খিত ইমপ্লান্ট কিনতে পারেন না, বিভাগ থেকে স্লিপ দিলে উক্ত সিন্ডিকেটের নির্ধারিত প্রতিনিধিরা তাদের নির্ধারিত উচ্চমূল্যে তা রোগীদের সরবরাহ করেন। কোন কোন জিনিসের দাম বাজার মূল্যের ৪/৫ গুণ বেশি দামে ক্রয় করতে বাধ্য করা হয়। বিভাগীয় প্রধান ও অনান্যদের নাকের ডগায় এই সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে এক চেটিয়া ব্যবসা করে সাধারণ রোগীদের জিম্মি করে রেখেছে।
অর্থোপেডিক্স বিভাগে পা ভাঙ্গা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রোগী চন্দন। তিনি বলেন, তার হাত ভেঙ্গে যাওয়ায় হাড় জোড়া লাগানোর জন্য স্ক্রু ও প্লেট কিনতে ২৫ হাজার টাকা লাগে। এই খানকার চিকিৎসকের মাধ্যমে আমরা কিনতে বাধ্য হইছি। ওই চিকিৎসকরা ফোন করে তাদেরকে ডেকে আনেন। আমরা ২৫ হাজার টাকা দিয়ে স্ক্রু ও ক্লাম কিনেছি। পরে জানতে পারছি ওর দাম আরও কম। তখন আর কি করার যেহেতু ডাক্তার বলেছে, তাই তাদের নিয়োজিত লোকের মাধ্যমে কিনতে বাধ্য হইছি। এদিকে বহিরাগতদের দিয়ে এ বিভাগের অপারেশনের রোগীদের ড্রেসিং করানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানেও রোগীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়া হয়। হাসপাতাল প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এ অনৈতিক কাজ চলে বলে জানা গেছে। অর্থোপেডিক্স বিভাগের কয়েক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোগীর অভিভাবক বলেন, পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। তাই প্লেট দিয়ে অপারেশন করাতে হবে বলে জানান একজন ডাক্তার। এই প্লেট খুলনায় নেই বলে ঢাকা থেকে আনার জন্য প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম নেয়া হয়। অপারেশন হয়েছে এমন কয়েক রোগীর অভিভাবক বলেন, ড্রেসিং করার জন্য দিলীপ নামক এক বহিরাগতকে টাকা দিতে হয়। অথচ দিলীপ এ হাসপাতালের কোনো কর্মচারী না। সরকারি কর্মচারী থাকলে রোগীরা ফ্রিতে ড্রেসিং করার সুযোগ পেতেন। এব্যাপারে খুমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা: মো: হুসাইন শাফায়াত বলেন, অর্থোপেডিক্স বিভাগের আলাদা ইউনিট করার জায়গা নেই। যে কারণে রোগীর সংখ্যাও বেশি। তিনি বলেন, দালালরা যাতে ওই ওয়ার্ড থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যেতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে অর্থোপেডিক্স বিভাগীয় প্রধান ও কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা: মো: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, কোন কোন রোগীর অপারেশনের জন্য একটি প্লেট প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু ওই রোগীটা স্ক্রুসহ সেট ধরে কিনে আনলো। কিন্তু ওটা মাপ মতো হলো না। কিন্তু দোকানদার তো ওইটা রোগীর কাছ থেকে ফেরত নেবে না। তখন রোগী অনেক টাকার ক্ষতি হবে। আমি সব চিকিৎসকদের বলে দিছি কেউ যদি কোন রোগীর কাছ থেকে মার্কেটের চেয়ে বেশি দাম নেওয়া হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। রোগীর ড্রেসিংয়ে বিষয়ে দিলীপ কোন রোগীর কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button