স্থানীয় সংবাদ

উপকূলের ফসলি মাঠে লবণের আস্তরণ

সাইক্লোন রেমাল

তিন যুগ পর ২২ নম্বর পোল্ডারেও লবণ

স্টাফ রিপোর্টার : সাইক্লোন রেমাল তা-বে আসা লবণ পানি নেমে গেছে; রেখে গেছে ধ্বংসের ছাপ। ফসলি মাঠে লবণের আস্তরণ জমে আছে। সবুজ জমিনে কালচে ছোপ ছোপ দাগ বসেছে। লবণে পুড়ে গেছে ভুট্টা, মরিচ আর তরমুজ ক্ষেত। লবণাক্ততায় পুকুর-ডোবার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। বহু ঘরের মাটির দেয়াল ধ্বসে পড়েছে লবণ পানির তোড়ে। গাছপালা মরে যাচ্ছে। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ২২ নাম্বার পোল্ডারের মানুষ এমন দৃশ্য এর আগে কখনো দেখেনি। রেমাল বিপন্নতায় লবণাক্ততায় ধ্বংসের মুখোমুখি তারা। যে কৃষি এলাকা মানুষের জীবিকার পথ দেখাতো; সেই কৃষি আজ বিপন্ন। শতভাগ কৃষিনির্ভর এলাকায় কৃষকদের চিন্তা আগামীর ফসল আবাদ নিয়ে।
রেমাল আঘাতের আগে কখনো এই অঞ্চলের মানুষ লবণাক্ততার মুখোমুখি হয়নি। ১৯৯০ সালে যখন লবণ পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষের জোয়ার উঠেছিল; তখনও দেলুটির ২২ নাম্বার পোল্ডারের মানুষ লবণ পানির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ ছিল। দাবিতে অটল থেকে তারা রক্ত দিয়েছে; তবুও লবণ পানি প্রবেশ করতে দেয়নি। আশপাশের সব এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য লবণ পানি প্রবেশ করানো হলেও এই পোল্ডারে সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ ৩৬ বছর পরে সেই ধারা ভেঙে দিলো রেমাল। এলাকার বাসিন্দারা বলেন, অনেক কষ্টে আমরা এলাকাটিকে লবণমুক্ত রেখেছিলাম। এর মাধ্যমে আমরা কৃষি বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। কৃষিতেই ছিল আমাদের জীবিকা। কিন্তু সেই রেওয়াজ ভেঙে গেল নিমিষেই।

শুধু দেলুটির এই এলাকাটি লবণমুক্ত ছিল; আশপাশের সব এলাকায় চাষ হতো লবণ পানির চিংড়ি। উন্নত দেশের ধনীদের রসনাবিলাসের জন্য তাদেরই সৃষ্ট ও নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর ফড়িয়াবাজিতে চিংড়ি-চক্রান্তের যে জাল পাতা হয় এই গরিব দেশের উপকূলে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন কম হয়নি। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চিংড়ি চাষবিরোধী তীব্র আন্দোলন হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলে। খুলনার পাইকগাছা ছিল এ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। একই সময়ে অন্যান্য স্থানেও গড়ে ওঠে চিংড়ি চাষে প্রতিরোধ। এজন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়েছে! এভাবে বেশ কিছু এলাকা চিংড়ি চাষমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। তার মধ্যে ২২ নাম্বার পোল্ডার একটি।
পাইকগাছার দেলুটি ও গড়ইখালী এ রকম দুটি চিংড়ি আগ্রাসনমুক্ত ইউনিয়ন। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন দেলুটি। সেখানকার চাষিরা তুলনামূলক ভালো আছেন। তরমুজ ও সবজির মৌসুমে এক বিঘা জমি থেকে লাখ টাকাও উপার্জন করেছেন সেখানকার চাষি। এসবই আন্দোলনের ফসল দাবি করে চিংড়ি চাষবিরোধী নেতারা জানান, দাকোপ ও বটিয়াঘাটার অনেক এলাকা চিংড়ি চাষমুক্ত। এসব এলাকার মানুষ বছরে দুবার ধান চাষ করেন। গরু, বাছুর আগের মতো উন্মুক্ত- পরিবেশটাই অন্যরকম! কিন্তু সাইক্লোন রেমাল দেলুটির সেই পরিবেশ কেড়ে নিয়েছে।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে শিবসা নদীর ওপারে যে দ্বীপ দেখা যায়, তার নাম দেলুটি। অন্যদিকে খুলনা শহরের গল্লামারী থেকে বটিয়াঘাটা সদর পেরিয়ে সামনে এগোলো ফুলবাড়ি বাজার পেরোলেই দেলুটি ইউনিয়ন। নদীর গা ঘেঁষে ঘুরে গেছে বেড়িবাঁধ। বাঁধের দুধারে বাবলা গাছের সারি আর ভেতরে সবুজে ভরা ছিল অন্যরকম এক গ্রাম। বাড়িগুলো ছাওয়া ঘন গাছপালায়। রয়েছে মাটির তৈরি অনেক বাড়ি। গোয়ালে আছে গরু; আছে সবজি ক্ষেত, ধানের আবাদ।
কিন্তু শিবসা নদীর ঠিক অন্যপাড়ে একই উপজেলার আরেকটি ইউনিয়ন সোলাদানা। এই ইউনিয়নের ছবি একেবারেই উল্টো। খোলা ফসলি মাঠের চিহ্ন নেই। এখানে আগে কোথায় খাল ছিল, কোথায় মাঠ ছিল ঠিক করে কেউ আর এখন বলতে পারে না। চারদিকে পানির ভেতর দিয়ে মাথা উঁচু করে আছে লবণে পোড়া বাড়িঘর। ঘরের সামনে উঠোনের কথা প্রায় ভুলেই গেছে এই ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষ। ঘর থেকে বের হলেই লবণ-পানি। চিংড়ি ঘেরের এই লবণ পানির কারণে জীবনের অনেক নিয়ম বদলাতে হয়েছে বাসিন্দাদের। সুপেয় খাবার পানির জন্য ব্যয় করতে হয় অনেকটা সময় ও শ্রম। গবাদিপশু লালন-পালন বাদ দিয়েছেন অনেকে। অথচ এক সময় এই এলাকা গ্রাম-বাংলার আর দশটা জায়গার মতোই ছিল সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা। সেই সোলাদানায় একদিন হানা দেয় চিংড়ি চাষ, আর দ্রুত বদলে যায় পরিবেশ। অথচ ৩৬ বছর ধরে ঠিকই টিকে ছিল দেলুটির সবুজ। এখন আর সোলাদানা এবং দেলুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকল না। সোলাদানার মতো দেলুটির মানুষদেরও লবণের সাথে লড়াই করতে হবে।
সাইক্লোন রেমাল আঘাতের পর এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিরা মনে করছিলেন সেই দিনের কথা। ১৯৯০ সালের কথা। চিংড়ি চাষিরা ফসলি মাঠ দখলে নিতে মরিয়া। অন্যদিকে খাস জমি লিজ নিয়ে ফসল আবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন যে ভূমিহীন মানুষ, তারা এর বিরোধিতা করেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হন ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ। একদিকে তৎকালীন প্রভাবশালী চিংড়ি চাষি ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসের লোকজন, অন্যদিকে দেলুটির সর্বস্তরের নাগরিক গোষ্ঠী। তুমুল লড়াইয়ে নাগরিক গোষ্ঠীর জয় হয় বটে, কিন্তু প্রাণ দিতে হয় দেলুটির ভূমিহীন সমিতির নেত্রী করুণাময়ী সরদারকে।
দেলুটির সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সমরেশ কান্তি হালদার বলেন, সাইক্লোন রেমাল-এর আগ অবধি এলাকাবাসীর আন্দোলনের ফসল হিসাবে টিকেছিল সবুজ দেলুটি। ইউনিয়নের আওতাধীন চারটি পোল্ডারের মধ্যে তিনটিই চিংড়ি চাষের আওতায় চলে গিয়েছিল। শুধু এই ২২ নাম্বার পোল্ডারটি চিংড়িমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছিল। স্লুইজ গেট ও পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও দেলুটি ব্যতিক্রম ছিল। স্লুইজ গেটগুলো পুরনো হলেও সংস্কার করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। নেদারল্যান্ড সরকার পরিচালিত ব্লুগোল্ড প্রকল্পের আওতায় স্লুইজ গেট সংস্কার করা হয়। স্লুইজ গেট ও পানি ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোও সক্রিয় এবং এর সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণ সম্পৃক্ত ছিল। এসব কারণে এই পোল্ডারের আওতাধীন ১৩টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ কৃষিকাজ করে বেশ ভালো ছিলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয় শেষ অবধি দেলুটিকে সবুজ থাকতে দেয়নি।
করুণাময়ীর আত্মত্যাগেও শেষ রক্ষা হলো না : চিংড়িবিরোধী আন্দোলনের নেতা করুণাময়ী সর্দারের আত্মত্যাগেও দেলুটির শেষ রক্ষা হলো না। ৩৬ বছর পরে রেমালের আঘাতে এই এলাকার সবুজ ঢেকে গেল লবণাক্ততায়। এলাকার বয়সী ব্যক্তিরা বলেছেন, চিংড়ি চাষবিরোধী আন্দোলনে করুণাময়ী সরদার ছিলেন সামনের সারিতে। প্রতিপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করতে এগিয়ে গিয়ে গুলির আঘাতে প্রাণ দিয়েছেন। এ কারণেই চিংড়িবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাসে ‘করুণাময়ী’ নামটি জ্বলজ্বল করছে। তাঁর হত্যাকা-ের দিন ৭ নভেম্বর এলাকার মানুষ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করে। দেলুটি ইউনিয়নের হরিণখোলা গ্রামে তাঁর স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ।
ভূমিহীন করুণাময়ী সরকারি খাস জমি বরাদ্দ নিয়ে সপরিবারে জমিতে ধান আবাদ করতেন। সংসারের প্রধান আয় ছিল এটাই। কিন্তু ধান চাষ টিকিয়ে রাখার সামনে বড় বাধা ছিল লোনা পানির চিংড়ি চাষ। ফলে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি। তাঁকে সমর্থন দেয় আরও অনেকে। আস্তে আস্তে চিংড়িবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। জীবিকার তাগিদে লড়াইয়ে নামে ভূমিহীন মানুষ।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করুণাময়ীর সাহসের কথা। ১৯৯০ সালের মে-জুন মাসের দিকে দেলুটিতে চিংড়ি চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তৎকালীন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস। ইউনিয়নের অন্যান্য এলাকা থেকে প্রায় ৪০০ বিঘা জমি লিজ নেন তিনি। ২২ নাম্বার পোল্ডারের জমিতেও লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার। কিন্তু এলাকার ভূমিহীনেরা কিছুতেই এ জমি ছাড়বে না। হরিণখোলা বিত্তহীন সমিতি রুখে দাঁড়ায়। বাঁধ কেটে লোনা পানি কিছুতেই জমিতে ঢোকাতে দেয় না তারা।
হরিণখোলা গ্রামে চিংড়িবিরোধী আন্দোলনের নেতা করুণাময়ী সর্দারের স্মৃতিস্তম্ভ
বাধ্য হয়ে সে বছর ৭ নভেম্বর বাঁধ কেটে লোনা পানি ঢোকানোর জন্য ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসের লোকজন আসে। যে কোনো মূল্যে তারা বাঁধ কাটবেই। এর বিপরীতে প্রস্তুতি নেয় ভূমিহীন সমিতির সদস্যরা। তারা মিছিল নিয়ে হরিণখোলায় হাজির হয়। ২২ নাম্বার পোল্ডারের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন জড়ো হয় ভূমিহীনদের সমর্থনে। সঙ্গে ছিলেন এলাকার ইউপি মেম্বারসহ নেতৃস্থানীয় লোকজন। দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থান ও বাদানুবাদের এক পর্যায়ে গর্জে ওঠে দখলদারদের বন্দুক। একের পর এক বোমা ফাটায় তারা। ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারদিক। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষের ছোড়া একটি গুলি সরাসরি আঘাত করে করুণাময়ীর মাথায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর মৃতদেহ পরে আর পাওয়া যায়নি। যেন দেলুটির সবুজের মাঝেই মিশে আছে করুণাময়ীর লাল রক্ত।
দেলুটিকে লবণমুক্ত রাখতে ১৯৯০ সালে ছিল মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই। কিন্তু এবার লড়াই প্রাকৃতিক বিপদের বিরুদ্ধে। সাইক্লোন রেমাল সবুজ কেড়ে নেওয়ার মর মানুষদের এখন সবুজ ফেরানোর লড়াইয়ে নামতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button