স্থানীয় সংবাদ

আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে দুস্কৃতিকারীরা তৎপর : সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র উপায়

খুলনাবাসী সাবধান

তৎপর থাকতে মসজিদে মসজিদে মাইকিং
শৃঙ্খলা ফেরাতে মাঠে শিক্ষার্থীরা
ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার্থে টহল টিম গঠন

স্টাফ রিপোর্টার : মুক্তিকামী ছাত্র-জনতার বিজয় উদযাপনের সুযোগে খুলনা মহানগরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে দুস্কৃতিকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করছে। নগরবাসী পাড়া-মহল্লায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ করতে পারলে এ ধরণের অরাজগ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। এটিই এখন একমাত্র উপায়।
এদিকে, নগরীতে শৃঙ্খলা ফেরাতে মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি লুটপাট ঠেকাতেও তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল এবং ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষার্থে টিম গঠন করে কাজ করছে। পাশাপাশি শহরের পরিচ্ছন্নতায়ও কাজ করছে শিক্ষার্থীরা। যদিও পাড়া-মহল্লায় স্থানীয় বাসিন্দাদের তৎপর থাকতে বিভিন্ন মসজিদে মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছে।
দিনে-রাতে লুটপাটের ভয়-আতঙ্কের মধ্যে মানুষ রয়েছেন। মধ্যরাতে মসজিদে মাইকে ঘোষণা আসছে, কেউ লুটপাট করতে আসলে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে সবাই এগিয়ে আসার জন্য। নগরীর বিভিন্ন সড়কের পাশে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ভাংচুর ও লুটপাটের খবর পাওয়া যাচ্ছে। হামলা করা হচ্ছে বাড়িতে। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাতের মহাসড়ক। দিনে-রাতে পুলিশ দায়িত্ব না থাকায় এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। পুলিশকে হামলার বিষয়ে অবহিত করলেও কোন সাড়া পাননি তারা। ভুক্তভোগীরা স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করলে কেউ ঘটনাস্থলে আসছেন না। অনেক এলাকায় লুটপাটদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে রাতে পাহাড়া দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারা এসব করছেন কেউ ভয়ে মুখ খুলছেন না। নাম প্রকাশের একাধিক ব্যক্তিরা জানান, কিছু টোকাই ও স্থানীয় কিছু উৎশৃঙ্খল যুবকরা এসব করছেন। তাদের হাতে রড. লাঠি. ধারালো অস্ত্র রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, অল্প বয়সী যুবকরা হাতে রড, ধারালো অস্ত্র ও লাঠি শোঠা নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন। ময়লাপোতা এলাকায় এক ব্যবসায়ীরা জানান, এ এলাকায় ২-৩ ফার্মেসীতে রাতে লুটপাটের চেষ্টা চালায়। পরে দোকান মালিকরা এক হয়ে রাতে পাহাড়া বসান। যাতে কেউ লুটপাট করতে না পারে। কেউ আসলে সবাই মিলে যাতে প্রতিরোধ করার জন্য সবাই এগিয়ে আসতে বলেন।
সূত্র মতে, জুলাই মাস থেকে এই পর্যন্ত দেশে ঘটেছে বেশ কয়েকটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কোটা সংস্কার ইস্যু নিয়ে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ। সর্বশেষ শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামে শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণ। ৫ আগষ্ট সোমবার বিকাল তিনটায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা দেন সেনাপ্রধান। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানের মত খুলনার আওয়ামী লীগ অফিস সহ নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে জনসাধারণ। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে পুষে রাখা চাপা ক্ষোভ ঝাড়েন জনগণ। এছাড়া দেশের সকল অধস্তন পুলিশ একযোগে কর্ম প্রত্যাহার করায়, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনায় ভুগছে খুলনাবাসী। সোমবার সড়কে তেমন কোন যানবাহন না দেখা গেলেও মঙ্গলবার হালকা পরিসরে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। পুলিশের কর্ম প্রত্যাহারের কারণে সড়কে যানজট সহ নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তবে শিক্ষার্থীরা খুলনা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দাঁড়িয়ে পালন করছেন ট্রাফিক পুলিশ’র কাজ। দেশের অন্যান্য স্থানের মত খুলনাতেও মঙ্গলবার সকাল থেকে যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা তৈরির কাজ শুরু করে শিক্ষার্থীরা। নগরীর প্রাণকেন্দ্র শিববাড়ি মোড়, নিউ মার্কেট, ফেরিঘাট মোড়, রয়েলের মোড় সহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন সুশৃঙ্খলভাবে চলাচলের ব্যবস্থা করেন শিক্ষার্থীরা।
দেশের চলমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী যেন জয়জয়কার শিক্ষার্থীদের। যেখানে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা সঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হয়েছে ট্রাফিক পুলিশকে। সেখানে শহরের শৃঙ্খলা ফেরাতে কাজ করে যাচ্ছে এক ঝাঁক কোমলমতি শিক্ষার্থী।
তাহরিম আলম নামক এক শিক্ষার্থী বলেন, দেশে নতুন স্বাধীনতার সুঘ্রাণ পেয়েছি। এদেশের শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করে যাব।
মিসবাহ আলম নামক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এদেশ আমার, আপনার, সকলের। সড়কে যানজট হলে জনসাধারণের সমস্যা সৃষ্টি হবে। তাই আমরা শৃঙ্খলা ফেরাতে সড়কে নেমেছি।
এদিকে টানা ৫ থেকে ৭ দিনের আন্দোলনে খুলনার সড়কে জমা পড়েছে ময়লা ও আবর্জনা। বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ের সামনে পড়ে আছে ধ্বংসস্তূপ। সড়কে জমে থাকা এসব ময়লা পরিষ্কারের কাজ করছেন শিক্ষর্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ কাজে যোগ দিয়েছেন সাধারণ মানুষও। দেখা যায়, সড়কে শিক্ষার্থীদের কারো হাতে ঝাড়ু, কারো হাতে পলিথিনের ব্যাগ। ব্যাগে রাখা হচ্ছে আবর্জনা। সড়কের ময়লা-আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে সাফ করছেন তারা।
মঙ্গলবার দুপুর ও বিকালে খুলনার বিভিন্ন মোড়ে এ চিত্র দেখা যায়। খুলনার শিববাড়ি মোড়ে দেখা যায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী হাতে ঝাড়ু পলিথিন ও ঝুড়ি নিয়ে সড়ক পরিষ্কার করছেন। একদল শিক্ষার্থীগন শিববাড়ি মোড় গোল চত্বরে বসে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, দেশটা আমাদের। এই দেশের পরিবেশ-রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। এখন সড়কে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা নেই, তাই আমরা নিজ উদ্যোগে দায়িত্ব নিয়ে খুলনার সড়ক এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। দেশের এই দুঃসময়ে আমরা শিক্ষার্থীরা জনগণের কল্যাণে কাজ করছি।
রিফাত আলম নামক শিক্ষার্থী বলেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে খুলনার সড়কগুলোতে বিশৃঙ্খলা এড়াতে আমরা ছাত্ররা কাজে নেমেছি।
এদিকে, সংখ্যালঘুদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে সর্বদা নিয়োজিত রয়েছেন শিক্ষার্থীসহ জনসাধারনেরা। বেশ কিছু স্থানে ব্যক্তিগত ঝামেলাকে কেন্দ্র করে ভাঙচুরও মারপিটের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল রাত ৯ টায় খুলনা রয়েল এর মোড়ে একটি মোবাইল দোকানে ভাঙচুর চালানো হয়। এছাড়া খুলনার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোর সংখ্যালঘুদের উপরে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিমা ভেঙে ফেলারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এ সকল বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি টহল টিম কাজ করছে বলে জানান আরমান হোসেন নামক বর্তমান শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দানকারী একজন সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমাদের এখন কাজ দুইটি। প্রথম কাজটি হলো শহর পরিচ্ছন্ন রাখা। দ্বিতীয় কাজটি ধর্মীয় উপাসনালয় দেখাশুনা করা। আমরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাস নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গাইড করছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে।
রয়েলের মোড়ে ভাঙচুর এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে কোন ছাত্র ভাঙচুর কিংবা হামলায় অংশগ্রহণ করছে না। যারা এ সকল কাজ করছেন তাদেরকে এ সকল কর্মকা- থেকে নিজেকে বিরত রাখতে অনুরোধ জানান তিনি।
এদিকে, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল সকালে খুমেক হাসপাতালে আরএমও ডা: সুমন রায় এর কক্ষে বাইরে টানানো নেমপ্লেট ভাংচুর করেছেন কতিপয় যুবকরা। এতে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কারা এ হামলা চালিয়েছেন স্পষ্টভাবে কেউ বলতে পারেননি। হাসপাতালে রোগী সংখ্যা কম দেখা যায়। অধিকাংশই হাসপাতালের বহি: বিভাগে চিকিৎসকদের কক্ষে পাওয়া যায়নি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা ভয়ে ও আতঙ্কে কর্মসংস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। হাসপাতালে ক্যান্টিনে হামলায় আশংকায় সোমবার থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন ওখানকার দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষ। কেউ কেউ জানান, পুলিশ নিরাপত্তা দিতে পারবে না বলে তাদের জানিয়ে দিয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button