স্থানীয় সংবাদ

বিল ডাকাতিয়ার কৃষকের স্বপ্ন পানিতে নিমজ্জিত

ভারী বৃষ্টিতে ডুবেছে মৎস ঘের ও সবজির ক্ষেত

মো. আশিকুর রহমান ঃ বিল ডাকাতিয়ার কৃষকের স্বপ্ন এখন পানিতে নিমজ্জিত। চলমান কয়েক দিনের বিরতিহীন ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তলিয়ে গেছে খুলনার বিল ডাকাতিয়া এলাকার বহু সংখ্যক মাছের ঘের, ঘেরপাড়ের সবজি ও ধানের জমি। ফলে বিল ডাকাতিয়ার ঘের সমূহ তলিয়ে যাওয়াই বিপাকে পড়েছে মৎস চাষীরা। অন্যদিকে ধানসহ ঘেরের পাড়ের সবজি সমূহের ব্যাপক ক্ষতি হওয়াতে অধিকাংশ কৃষকের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ। পর পর সমুদ্রে সৃষ্ট দু’টি লঘুচাপের প্রভাব এবং বিগত এক সপ্তাহ ধরে মৌসুমি বায়ূ সংক্রীয় থাকার কারণে লাগাতার এই বৃষ্টিপাত অব্যহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা আবহাওয়া অধিদপ্তর। একই সাথে ওই দপ্তরের সর্বশেষ তথ্যনুসারে, ২৭ আগষ্ট বিকাল ৩টা পর্যন্ত আগষ্ট মাসে খুলনায় সর্বমোট বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৪৫৭ মিলিমিটার। গত কয়েকদিনের বিরতিহীন ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে বিল ডাকাতিয়ার বহু সংখ্যক ঘের, ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ধানসহ ঘের পাড়ের সবজিও। এমনিতেই এখানকার স্থায়ী জলবদ্ধতা। তার উপর কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাত। নিচু এলাকা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে ডাঙ্গার পানি প্রবেশ করে। পানি নিষ্কাশনের খালগুলো নিয়মিত সংস্কার করা হয় না। তারপরও প্রতি বছর বিল ডাকাতিয়াকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার কৃষিজীবি এবং মৎস্যজীবি মানুষগুলোর যে স্বপ্ন দেখে থাকে, সেই স্বপ্নগুলো প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণের শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে বিল ডাকাতিয়ার হাজারো মৎসজীবি ও কৃষিজীবির স্বপ্ন এখন পানিতে নিমজ্জিত। নিদারুন কস্টে চলছে তাদের জীবন সংগ্রাম। জানা যায়, খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলা ও আড়ংঘাটা থানার বিল ডাকাতিয়ার অবস্থিত পোল্ডারের মোট এলাকা প্রায় ১৯ হাজার ৪৩০ হেক্টর। স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ হাজার হেক্টর বা মোট এলাকার প্রায় ৫০ শতাংশ স্বাভাবিক ভাবে পানির নীচে তলিয়ে থাকে। ৮০ ‘র দশকে বিলটিতে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার হেক্টর জমিতে বছরে ৩টি ফসল উৎপাদন হতো। ১৯৮৪ সালে বন্যায় বিল ডাকাতিয়া অঞ্চল চরমভাবে প্লাবিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বিলের পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল খনন করা হলেও খালগুলি নিয়মিত সংস্কার না করায় প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। যার মাশুল দিতে হয় ওই অঞ্চলের সাধারন কৃষকসহ মৎস চাষিদের। স্থায়ী জলবদ্ধতায় পড়ে ক্ষতি সাধিত হয় ক্ষেতের ধান ও বিভিন্ন ক্ষেত ও ঘেরের পাড়ের সবজিসহ শত শত বিঘা ঘেরের। ওই এলাকার কৃষক ও মৎস চাষিরা জানান, আমাদের এই বিল ডাকাতিয়া তেলিগাতি মৌজায় শতাধীক মাছের ঘেরসহ ধান এবং ঘেরের পাড়ে বিভিন্ন সবজির মধ্যে ঝিঙে, লাউ, করোল্লা, শষা, বরবটি সীমসহ অন্যান্য সবজিব চাষাবাদ করে থাকি। কিন্তু কয়েকদিন ধরে লাগাতার ভারী বর্ষণের কারণে ইতোমধ্যে বহু ঘের তলিয়ে গেছে, ভেসে গেছে মাছ। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ধানের জমিসহ ঘের পারের সবজির। পানিতে সবজি তলিয়ে চাওয়ার দরুন গাছের গোড়া পড়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক এবং মৎস্য চাষী এবং ঘের মালিকরা দাবি জানিয়েছেন খালগুলি নিয়মিত খনন করে পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার। বিল ডাকাতিয়া তেলিগাতি মৌজার ঘের মালিক মালিক আশিষ সরদার জানান, আমার দেড় বিঘার ঘেরে সাদা মাছ দিয়েছিলাম। একই সাথে ঘের পাড়ে বহু সবজি ছিল। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিপাতের কারণে আমার দেড় বিঘার ঘেরটি তলিয়ে যায়। এই বৃষ্টিকারণে ঘের ও ঘেরের পাড়ের সবজি সব শেষ। সারা বছরের কষ্টই বৃথা। লাভ তো দূরের কথা, ব্যবসায় যে টাকা খাটালাম হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলাম তার সবই বৃথা। তেলিগাতী মৌজার বিল ডাকাতিয়ার ঘের মালিক আবজাল জানান, প্রতি বছর বিল ডাকাতিয়ায় ৫ হাজার মাছের ঘের তলায় যায়। পানি সরার কোন ব্যবস্থা নেই। নদীতে পানি যাওয়ায় খালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতি বছর একই রকমভাবে তলিয়ে যায় বিল ডাকাতিয়া। নদীর পাশে যে গেট আছে সেগুলো কোন কাজ করে না। যে কারণে প্রতি বছর আমাদের ঘের তলিয়ে যায়, ব্যাপক ক্ষতি হয় ঘের পাড়ের সবজিরও। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ডাঙ্গার পানি এসে বিলের ভিতর জমতে থাকে। ওই এলাকার ঘের মালিক রিপন জানান, বিল ডাকাতিয়ায় পানি সরার কোন ব্যবস্থা নেই। আমরা গরীব মানুষ, বিভিন্ন এনজিও সংস্থা হতে লোন করে ঘের বেড়ি বাধ দেই। লোনের টাকা দিয়ে ঘেরে মাছ ছাড়ি। মাথার উপর ঋণের বোঝা নিয়ে ঘেরে মাছের চাষাবাদ করি। কিন্তু দুঃখ জনক বিষয় প্রতিটি বছরই বৃষ্টিতে ঘের তলিয়ে যায়। মাছও ভেসে যায়। ৪/৫ বছর ধরে ডাকাতিয়া বিল তলায় যায়। এবছর ঘের ভেঁড়ি সব তলায় গেছে। এখন এই ঋনের মোঝা মাথা নিয়ে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। বিল ডাকাতিয়া তেলিগাতি মৌজার ঘের মালিক অপূর্ব সরকার জানান, আমার বিল ডাকাতিয়া তেলিগাতি মৌজায় ২৬ কাঠা ঘের আছে। ঘেরটিতে আমি সাদা মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্লাস কাপ) দিয়েছি। তাছাড়া ঘেরের পাড়েরও সবজি চাষ করেছি। কয়েকদিনের টানা বর্ষণে বহু ঘের তলিয়ে গেছে। আমার ঘেরটি এখনো তলিয়ে যায়নি। তলিয়ে যেতে ৬ ইঞ্চি বাকি আছে। এভাবে বৃষ্টি চলতে থাকলে আমার ঘের আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না, ডুবে যাবে। চরম দুঃচিন্তায় দিন কাটাচ্ছি। বিল ডাকাতিয়ার অন্যতম বড় ঘের ১০ বিঘার ঘের। ঘের মালিক বাকি উল্লাহের ছেলে ওলিয়ার রহমান বলেন, বৃষ্টির কারণে ঘেরের সব মাছ ভেসে গেছে। সারা বছরের স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। দিঘলিয়া উপজেলার কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পরিতোষ বৈরাগী জানান, আমার ব্লকটি তেলিগাতি বিল ডাকাতিয়ায়। আমি যোগিপোল ইউনিয়নের ৭,৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করি। আমাদের সার্বিক সহযোগীতায় এখানকার ৮ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছেন। গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণের কারণে ধানসহ ঘেরের পাড়ের সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বহু ক্ষেতের সবজি এখনো পানির তলে ডুবে আছে। ভারী এই বৃষ্টিপাতের কারণে কৃষকেরা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পুনবার্সনের ব্যবস্থার জন্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত ভাবে জানাবো। দিঘলিয়া উপজেলার কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিশি কান্ত রায় জানান, আমার ব্লকটি তেলিগাতি বিল ডাকাতিয়া সংলগ্ন এলাকায়। আমি যোগিপোল ইউনিয়নের ১ হতে ৬নং ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করি। আমাদের সার্বিক সহযোগীতায় এখানকার ৭ হেক্টর জমিতে কৃষকেরা বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ধানের চাষ করেছেন। যার মধ্যে ২ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ এবং ৫ হেক্টর জমিতে সবজির চাষাবাদ করেছেন কৃষকেরা। গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণের কারণে দেড় হেক্টক ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সাথে ঘেরের পাড়ের সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরপর যদি এই বৃষ্টি চলমান থাকে তবে সম্পূর্ন জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার কিশোর আহম্মেদ জানান, আমাদের দিঘলিয়া উপজেলা কৃষি অফিস হতে বিল ডাকাতিয়ায় ধানের আবাদ করা হচ্ছে আড়াই হেক্টর এবং সবজির চাষাবাদ করা হচ্ছে ১৩ হেক্টর। গত কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ওই এলাকায় ধানের ক্ষতি হয়েছে ২ হেক্টর এবং সবজির ক্ষতি হয়েছে ৫ হেক্টর জমি। দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পুর্নবাসনের উদ্যোগ গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানান।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button