‘বাবার স্পর্শ পাইনি সাত বছর, জীবিত না মৃত সেটাও অজানা’

প্রবাহ রিপোর্ট : ইমন ওমর (৩০) গত তিনদিন যাবৎ বাবার খোঁজে ঢাকায়। দীর্ঘ সাত বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে তার বাবা ওমর ফারুককে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। সেই থেকে র্যাব, সংশ্লিষ্ট থানাসহ নানা জায়গায় খুঁজেছেন। কিন্তু বাবার সন্ধান মিলেনি। তবে শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতনের পর ডিজিএফআইয়ের ‘আয়নাঘর’ থেকে সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও আহমাদ বিন কাসেমের ফিরে আসার খবরে তিনি লক্ষীপুর থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন। গত ৯ আগস্ট বাবার খোঁজে যান ডিজিএফআই কার্যালয়ের সামনে। সেখানে গিয়ে হতাশ হয়ে দাঁড়ান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে। গতকাল রোববার মানবাধিকার সংস্থা ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত মানববন্ধনে বাবার খোঁজে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার একটাই দোষ তিনি বিএনপি করতেন। তিনি লক্ষীপুর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এই কারণে আমার বাবাকে ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে র্যাব পরিচয়ে গুম করা হয়। সেই থেকে আমরা বাবার অপেক্ষায়। বাবার স্পর্শ পাইনি সাত বছর, জীবিত না মৃৎ সেটাও অজানা। আমার চাওয়া, জীবিত বা মৃত হোক আমার বাবার সন্ধান চাই আমরা।’ ইমন ওমরের মতো প্রায় ৩০ পরিবার স্বজনদের খোঁজে জাতীয় শহীদ মিনারে দাঁড়ান। যাদের অনেকের বাবা-ভাই ও সন্তান বছরের পর বছর নিখোঁজ। দীর্ঘদিন হলেও নিখোঁজ স্বজনরা জীবিত না মৃত সেই তথ্যটিও তাদের অজানা। তাই স্বজনরা নিখোঁজ হওয়া সদস্যের বর্তমান অবস্থা জানতে গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাতীয় শহীদ মিনারে জড়ো হোন। সেখানে তাদের বক্তব্যে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রেহেনা বানু (৪৫) ভাইয়ের খোঁজে শহীদ মিনারে পাদদেশে বসে কান্না করছিলেন। তার কান্নায় উপস্থিত সবার চোখ টলমল করছিলো। তিনি বারবার নিখোঁজ মো. সেলিম রেজা পিন্টুর ছবি উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের দেখাচ্ছিলেন। আর আর্তনাদ করে আর্তি জানাচ্ছিলেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে, তারা যাতে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের ফেরাতে ব্যবস্থা নেন। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মাঝরাতে পল্লবীর আমার আরেক ভাইয়ের বাসা থেকে মধ্যরাতে ডিবি পরিচয়ে অস্ত্রের মুখে তাকে তুলে নেওয়া হয়। আমার ভাইয়ের একমাত্র অপরাধ ছাত্রদল করা। আমার ভাই সূত্রাপুর থানা ছাত্রদল সভাপতি ছিলেন। এই একটি কারণে তাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নেয় আওয়ামী সন্ত্রাসী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সেই থেকে আমরা ভাইয়ের খোঁজে থানাসহ হাইকোর্ট পর্যন্ত গেছি। কিন্তু কোন সুরহা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই গুম করা ঘটনাগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের স্বজনদের খোঁজ দিতে হবে। যদি মেরে ফেলা হয় সেটাও অন্তত জানানো হোক। আর বেঁচে থাকলে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।’ মানবাধিকার সংস্থা ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ সিনিয়র রিসার্সার তাসখিন ফাহিমা। তিনি মানববন্ধনে অংশ নিয়ে বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়া পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমরা র্যাব, পুলিশ, ডিজিএফআই কথা শুনতে পাই। পরে আমরা নিজ থেকেই নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে স্বজনদের অভিযোগগুলোর সত্যতা পাই। অধিকার রিপোর্টে আমরা দেখিয়েছে প্রায় ৭০৪জন মানুষকে গুম করা হয়েছে। তাদের মধ্যে দেড়শ মানুষ এখনো ফিরে আসেনি। তারা এখন কোথায়, আমরা জানতে চাই। আমরা অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে গণকমিশন চাই। যাতে এসব ঘটনার বিচার হয়।’ গুমের শিকার পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি মানববন্ধন থেকে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিসমূহ হলো- প্রথমত জোরপূর্বক গুমের শিকার সকল ব্যক্তিকে আয়নাঘরে মতো বন্দিশালাসমূহ থেকে নিঃশর্ত মুক্ত করা এবং নিজ নিজ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে, দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ তত্ত্বাবধানে জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের জন্য নাগরিকদের তত্ত্বাবধানে একটি কমিশন দ্রুত প্রতিষ্ঠা করা, তৃতীয়ত গুমের সঙ্গে জড়িত প্রমাণিত সকল রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ব্যক্তিবর্গকে বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং সকল আয়নাঘরসমূহ ভেঙে দিয়ে নাগরিকবৃন্দের জন্য জাদুঘর তৈরি করতে হবে। এ সময় সমন্বয়ক সানজিদা আক্তার তুলি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে গুমের শিকার মানুষদের খুঁজে পেতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। অতীতে শেখ হাসিনা সরকার আমাদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দিতো না। প্রোগাম থাকলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখিয়ে বাধা দেওয়া হতো। কিন্তু আজকে সেই অবস্থার মুখে পড়তে হয়নি। কারণ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। তাই আমরা এখন অন্তত বাক-স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আগামী ২৪ ঘণ্টার ভিতরে আমরা আমাদের দেওয়া দাবিসমূহের বিষয়ে জানতে চাই।’



