জাতীয় সংবাদ

লক্ষ্মীপুরে ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানি বেড়েই চলেছে। নোয়াখালীর বন্যার পানি আসা, একইসঙ্গে গতকাল বুধবার ভোরে ভারী বৃষ্টিপাতে এ জেলায় পানির উচ্চতা আরও বেড়েছে। ফলে লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত টানা বৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ফলে দুইদিন আগেও যে সব ঘরে পানি উঠেনি গতকাল বুধবার তাদের ঘরে পানি উঠার খবর পাওয়া গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত মঙ্গলবার পানির উচ্চতা তেমন একটা না বাড়লেও গতকাল বুধবার ভোরে পানির উচ্চতা বাড়ায় তাদের মধ্যে নতুন করে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। জেলার সর্বত্র পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে। পানি বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নাছিমা বেগম বলেন, গতকালও (গত মঙ্গলবার) ঘরে পানি ছিল না। কিন্তু আজকের বৃষ্টিতে ঘরে পানি ঢুকে গেছে। পানি উঠায় খুবই দুর্ভোগে পড়েছি। সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের রমাপুর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, গত মঙ্গলবার পানি কিছুটা কম ছিল। কিন্তু আজকে (গতকাল বুধবার) আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। এলাকার পানিবন্দি বাসিন্দারা চরম কষ্টে আছে। লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান বলেন, যে পরিমাণ পানি চাপ, সে হিসেবে পানি রেগুলেটর দিয়ে বের হতে পারছে না। বুধবারের বৃষ্টির কারণে পানির উচ্চতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে বন্যায় লক্ষ্মীপুরের প্রায় সবকটি এলাকা পানির নিচে তলিয়ে আছে। রাস্তা-ঘাট, ফসলি মাঠ, বাড়ির উঠোন, রান্না ঘর সবখানে এখন পানি আর পানি। কোথাও বুক পরিমাণ পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত আবার কোথাও হাঁটুপানি। ঘরের ভেতরেও পানি। চারিদিকে থই থই করছে পানি। পানিতে তলিয়ে আছে নলকূপ, শৌচাগার। প্রায় মসজিদ কিংবা উপাসনালয়ের ভেতরেও পানি ঢুকে আছে। কোনো কোনো মসজিদে এখন আর নামাজ হয় না। শুধু আযান হয়। আবার কোনো মসজিদে ব্যবস্থা নেই ওযুর পানি। বাধ্য হয়ে বন্যার অপরিষ্কার পানি দিয়েই ওযু করতে হয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দুর্গত গ্রামের বাসিন্দাদের। বন্যার পানির সঙ্গে শৌচাগার একাকার হয়ে আছে। সুপেয় পানির সংকট তো আছেই। দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগের শঙ্কায় রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বৃদ্ধ এবং শিশুরা। গত কয়েকদিনে সদর উপজেলার বন্যা কবলিত পৌর এলাকা, লাহারকান্দি, মান্দারী, দিঘলী, দত্তপাড়া, বাঙ্গাখাঁ, পার্বতীনগর, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জের মিয়ার বেড়ি এবং কমলনগর উপজেলার চরকাদিরার একাংশ, রামগতি উপজেলার চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে গিয়ে মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেছে। বেশিরভাগ লোকজনের ঘরে পানি ঢুকে আছে। অধিকাংশ বাসিন্দা ঘর-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রেও উঠেননি। ঘরে মূল্যবান সামগ্রী নিরাপত্তার জন্য ঘরেই অবস্থান নিয়েছেন তারা। তবে ঘরে থাকার মতো যাদের একেবারে উপায় নেই, তারা আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের ভবন কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে। এদিকে বাড়িতে যে সব পরিবার অবস্থান নিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ রান্নার কাজে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। যাদের গ্যাস সিলিন্ডার আছে, তারা রান্না করতে পারছেন। আবার কেউ কেউ অস্থায়ীভাবে লাড়কির চুলো তৈরি করে নিয়েছেন। কিন্তু টানা বৃষ্টি এবং বন্যার পানি থাকার ভেজা লাকড়ি দিয়ে রান্নার কাজও করতে পারছেন না। ফলে শুকনো খাবারে ভরসা রাখতে হচ্ছে তাদের। কুশাখালীর পূর্ব কল্যাণপুর গ্রামের একজন মৎস্য শিকারি বলেন, ঘরের ভেতরে পানি। রাস্তাঘাট বাড়ির উঠানে পানি। যেদিকে যাই, সেদিকে পানি। তাই বাড়িতেই যাই না। খালের ওপর মাছ শিকারের জন্য একটি মাচা তৈরি করে নিয়েছি, ওই মাচাতেই দুই ছেলেকে নিয়ে রাতে ঘুমায়। পানির কারণে ঘরে থাকি না। দিঘলী এলাকার একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া নারী সখিনা বেগম বলেন, ঘরে পানি উঠায় আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছি। কেন্দ্রটি একতলা ভবন। এখন ভবনের ভেতরেও পানি ঢুকার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হয়ত আশ্রয় কেন্দ্রেও থাকতে পারবো না। একই এলাকার বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, মান্দারী থেকে দিঘলী সড়কের মাঝ বরাবর অংশে পানির উচ্চতা অনেক বেশি। বিশেষ করে ওয়াপদা খালপাড় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বুক সমান পানি। খালের পশ্চিম এবং পূর্ব পাড়ের লোকজন পুরোপুরি আটকা পড়ে আছে। নৌকা না থাকায় সেসব এলাকায় কেউ যেতে পারছে না। ত্রাণও পৌঁছায় না। দিঘলী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) মোসলেহ উদ্দিন বলেন, সবচেয়ে বেশি পানি আমাদের এলাকাতে। গলা পরিমাণ পানি। স্থানীয় শানকিভাঙা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৭ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এলাকার লোকজন চরম খাদ্য সংকটে আছে। অনেকের রান্না করার মতো ব্যবস্থা নেই। মান্দারী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. সুমন বলেন, ইউনিয়নের সবগুলো ওয়ার্ডের অবস্থা শোচনীয়। সবার ঘরেই পানি। টিউবওয়েল পানির নিচে। শৌচাগার নেই। সুপেয় পানির চরম সংকট। যে দু-একটি টিউবওয়েল এখনও পুরোপুরি ডুবেনি, দূরদূরান্ত লোকজন সেখান থেকে সুপেয় পানির চাহিদা পূরণ করে। কুশাখালী ইউনিয়নের পূর্ব কল্যাণপুর গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হক বলেন, মসজিদে ভেতরে পানি। তাই মুসুল্লিদের নামাজ পড়ার মতো অবস্থা নেই। মসজিদে শুধু আযান হয়। লক্ষ্মীপুরের বন্যা পরিস্থিতি বিষয়ে জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানান, লক্ষ্মীপুরে সাত লাখ ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। এ পর্যন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৩০ হাজার মানুষ। পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button