জাতীয় সংবাদ

বন্যায় মৃতের সংখ্যা একলাফে বেড়ে ৫২

হেলিকপ্টারে ৬ রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর : ১৬ জনকে উদ্ধার: আইএসপিআর
বন্যা কেড়ে নিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই : প্রত্যন্ত অঞ্চলে ১০ দিনেও মেলেনি ত্রাণ, ত্রাণ বিতরনে হ-য-ব-র-ল অবস্থা
সারাদেশে ত্রাণ দিচ্ছে মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে : সেই ত্রাণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছাচ্ছে না

প্রবাহ রিপোর্ট ঃ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। মৃতের এ সংখ্যা গতকাল (বুধবার) ছিল ৩১ জন। বুধবার (২৯ আগস্ট) দুপুর ১টা পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যায় কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ১৭, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াাছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও কক্সবাজার ৩ জন মারা গেছেন। এছাড়া, মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যায় ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯ পরিবার পানিবন্দি হয়েছেন। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট তিন হাজার ৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট পাঁচ লাখ দুই হাজার ৫০১ জন মানুষ এবং ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য মোট ৫৯৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। এছাড়া, দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। অপরদিকে বন্যাদুর্গত এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ছয়জন মুমূর্ষু রোগীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে ১৬ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অগ্রগতি প্রতিবেদনের ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বুধবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্ভাব্য সব পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা ও ত্রাণ বিতরণের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর আর্মি অ্যাভিয়েশন গ্রুপের ১৬টি হেলিকপ্টার সর্টির মাধ্যমে ফেনী সদর, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, মধুগ্রাম ও সেনবাগ এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এতে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ৬ জন মুমূর্ষু রোগীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে স্থানান্তর এবং ১৬ ব্যক্তিকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। এ ছাড়া প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও ৯ হাজার ২২৮ কেজি ত্রাণ, ৬৫০ লিটার বিশুদ্ধ পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বন্যাকবলিত এলাকায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩টি ফিল্ড হাসপাতাল ও ১৮টি মেডিকেল টিম বন্যাদুর্গতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর এ কার্যক্রম চলমান থাকবে। সারাদেশ থেকে ব্যাপক আকারে ত্রাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। জনগণ স্বতস্ফূর্তভাবে ত্রাণ দিচ্ছে কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক সেনা নৌ বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও ফায়ার সার্ভিসের কিছু জওয়ানরা ছাড়া কেউ যাচ্ছে না। ফলে বেশিরভাগ মানুষ খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কটে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে। বন্যা দুর্গত এলাকায় উদ্ধার অভিযান এবং ত্রাণ বিতরণ নেমেছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গত ২১ আগস্ট থেকে প্রতিদিনই ট্রাক ভরে ত্রাণ নিয়ে দুর্গত এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন। ত্রাণ সামগ্রীর কোন অভাব নেই। তবে ত্রাণ বিতরণে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। একই অঞ্চলে অনেকে বার বার ত্রাণ পাচ্ছে, আবার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ত্রাণ পৌঁছাছে না। অনেক দুর্গম এলাকায় বাড়ির ছাদে না খেয়ে প্রচুর মানুষ দিন কাটাচ্ছে। ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় দ্রুত সমন্বয় আনা জরুরি। বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্ট নিচে দেওয়া হলো। নোয়াখালী থেকে বদরউদ্দীন জানান, প্রবল বর্ষণ ও ভারতের ঢলে নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলার প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে খাদ্য সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদিকে পাকা বসতঘর, গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু নিয়ে সুখের সংসার ছিল ফাতেমা খাতুনের। কয়েক বছর আগে স্বামী আবু তাহের মারা যাওয়ার পর থেকেই যেন বারবার হোঁচট খেয়েই চলেছেন জীবনযুদ্ধে। শেষ আশ্রয় ভাঙা বসতঘরটাও এবারের বন্যায় তলিয়ে গেছে। একটু ত্রাণের আশায় ঘুরছেন এদিক-সেদিক। কিন্তু ১০ দিনেও মেলেনি এক প্যাকেট ত্রাণ। ফাতেমা খাতুন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের চতইল্লা গ্রামের বাসিন্দা। চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি জানান, তিন মেয়েকে নিয়ে তাঁর পরিবার পানিবন্দী। এখন পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাননি। ত্রাণের আশায় তিনি বাজার এলাকায় এসেছেন। তাঁর মতো হাজারো বাসিন্দা পানিবন্দী হয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। ‘৬০ বছর বয়সে কখনো মান্দারী এলাকায় বন্যার পানি দেখিনি। অভাব-অনটনের কারণে আমাকে আর কত কাঁদতে হবে? এত কষ্টের জীবন আমি চাই না’, আক্ষেপ করে এ কথা বলেন ফাতেমা। লক্ষ্মীপুর জেলার ৯০ ভাগ এলাকাই এখন পানির নিচে। প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী। দুর্গত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ হতদরিদ্র। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া জানান, এ পর্যন্ত ৭৮০ মেট্রিক টন চাল দুর্গত এলাকায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগদ ৩০ লাখ টাকাও দেওয়া হয়েছে বানভাসি মানুষের জন্য। বুধবার বিকেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিঘলী, চরশাহী, বাঙ্গাখাঁ ও মান্দারী ইউনিয়নের দুর্গম এলাকায় পানির কারণে যাতায়াত করা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত পানির কারণে গ্রামীণ সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেখানকার পানিবন্দী মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। এসব এলাকায় ত্রাণ বিতরণে নৌকার কোনো বিকল্প নেই। মান্দারী-দিঘলী সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে আছে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নোয়াখালীর পানি লক্ষ্মীপুরে অনবরত ঢুকছে। যে পরিমাণ পানির চাপ, সে হিসেবে রেগুলেটর দিয়ে বের হতে পারছে না। এ ছাড়া রায়পুর ও রামগঞ্জে পানি কিছুটা কমেছে। রামগতি ও কমলনগরে বেড়িবাঁধের বাইরে ভুলুয়া নদী এলাকায় অনেক মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। নোয়াখালীর পানি এসে ভুলুয়া নদীতে যুক্ত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button