অর্থের বিনিময়ে কারিগরি বোর্ড থেকে বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার জাল সনদ
প্রবাহ রিপোর্ট : অর্থের বিনিময়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে বিক্রি হয়েছে হাজার হাজার জাল সনদ। আর ওসব জাল সনদ কিনে অনেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, এগ্রিকালচার, ফিশারিজ, লাইভস্টক, ফরেস্ট্রি, মেডিক্যাল টেকনোলজির মতো বিষয়ে দেশে-বিদেশে চাকরি করছেন। আবার অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। মূলত শিক্ষা বোর্ডের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী অর্থের বিনিময়ে গত এক যুগে জাল সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন। প্রায় ৩০ হাজার শুধুমাত্র কম্পিউটার শিক্ষার নকল সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে। আর ওই সার্টিফিকেটে কয়েক হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষকও হয়েছে। জাল সনদ বানিয়ে তা রেজাল্টের তথ্য বোর্ডের সার্ভারে আপলোড করে দেয়া হতো। ফলে বোঝার উপায় ছিল সনদ নকল না আসল। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, একটি অসাধু চক্র জাল সনদ বিক্রি করতে দেশ জুড়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলো। বোর্ড থেকে মাত্র ৩৫ থেকে ৫০ হাজার টাকায় ওসব জাল সনদ বিক্রি করা হতো। তবে দালালরা ক্রেতাদের কাছ থেকে ন্যূনতম ২ লাখ টাকা নিতেন। পুরো অসাধু চক্রে প্রায় ৫০ জন রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা, পরিচালক ও কর্মচারী। বর্তমানে জাল সনদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী বিপুল পরিমাণ তৈরি করা জাল সার্টিফিকেট, মার্কশিট, রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র এবং ওসব তৈরিতে নানা সরঞ্জামসহ বোর্ড থেকে চুরি করে নেয়া হাজার হাজার অরিজিনাল সার্টিফিকেট এবং মার্কশিটের ব্লাঙ্ক কপি, ট্রান্সক্রিপ্ট, বায়োডাটা, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। সূত্র জানায়, জাল সনদ বিক্রি করে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্ট অসাধু চক্র বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর সাথে রাঘব-বোয়ালরা জড়িত। এখনো তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। মূলত পরীক্ষা কোনো প্রার্থী পছন্দমতো স্কোর করতে না পারলে কিংবা ফেল করলে ওই পরীক্ষার্থী কারিগরি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেটের দ্বারস্ত হতেন। তারপর প্রয়োজনীয় ঘুষের টাকা জমা দিয়ে পছন্দমতো সনদ নিতেন। পরীক্ষা দিয়ে কেউ হয়তো সিজিপিএ-২ স্কোর পেলেন। টাকা দিলে সেটি সিজিপিএ-সাড়ে ৩ হয়ে যেত। পরবর্তী সময় স্কোরের সনদ অনলাইনেও আপলোড করা হতো। এমনভাবে সনদটি দেয়া হতো সেটি মোটা দাগে ধরার কোনো সুযোগ থাকতো না। বিগত ২০০৭ থেকে এ অপকর্ম শুরু হলেও ২০১২ সাল থেকে ব্যাপক হারে বাড়ে। দেশ জুড়ে একাধিক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরা ওই চক্রের সঙ্গে জড়িত। সূত্র আরো জানায়, করিগরি শিক্ষা বোর্ড দীর্ঘদিন ধরেই জাল সনদের বৈধতা দিয়ে আসছে। সনদ যাচাইয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য না দিয়ে তারা জাল সনদধারীদের সুরক্ষা দিতো। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, নিয়োগের বৈধতা ও একাডেমিক সনদ যাচাই করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। প্রতিষ্ঠানটি গত এক দশকে কয়েক হাজার জাল সনদধারী শিক্ষককে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তারা। সম্প্রতি পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জাল সনদসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেখানে ১ হাজার ১৫৬ জন শিক্ষকের জাল সনদের তথ্য দেয়া হয়। এর মধ্যে ২৯৬ জনের কম্পিউটার শিক্ষার সনদ জাল। যার অধিকাংশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে নেয়া হয়েছে। চলতি অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জাল সনদে চাকরি করা ২০২ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। অভিযোগ রয়েছে, কারিগরি বোর্ড সংস্থা সনদ যাচাই করতে সহায়তা করে না। দীর্ঘ এক দশকে কয়েক হাজার শিক্ষকের সনদ যাচাই করে দিতে বললে কারিগরি বোর্ড থেকে নামমাত্র কিছু সনদ যাচাই করে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, একাধিকবার চিঠি দিলেও কারিগরি বোর্ড থেকে সদুত্তর মেলেনি। কারিগরি বোর্ড থেকে যত জাল সনদ তৈরি হয়েছে তার একটি বড় অংশ কম্পিউটার প্রশিক্ষণের সনদ। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আইসিটি শিক্ষক পদে এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য এ সনদ বাধ্যতামূলক। সরকার ২০১১ সালে প্রতিটি স্কুলের জন্য একজন কম্পিউটার শিক্ষক আবশ্যক বলে ঘোষণা দেয়। এছাড়া দেশের বাইরে পড়াশোনা বা চাকরির জন্য কম্পিউটার সনদের বেশ কদর রয়েছে। এ সুযোগে কারিগরি বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেদার আইসিটির ওপর বিভিন্ন স্বল্প মেয়াদের কোর্সের নামে সনদ বিক্রি শুরু করে। আর কারিগরি বোর্ড সেসব সনদের বৈধতা দেয়। নতুন শিক্ষকরা ওই সনদ দেখিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন এবং পরে তা দেখিয়ে এমপিওভুক্ত হন। সারা দেশে প্রায় ৩৬ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত। এর মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার কম্পিউটার শিক্ষক রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই জাল সনদে চাকরি করছেন। এদিকে কারিগরি বোর্ড সংশ্লিষ্টদের মতে, বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা সনদ যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হলে তা পত্রগ্রহণ শাখা থেকে গায়েব হয়ে যেতো। কিছু কিছু যদিও আসলেও তা সংশ্লিষ্ট শাখা বা সচিবের দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছাতো। এরপর ওই চিঠির কোনো হদিস পাওয়া যেত না। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রাকিব উল্লাহ জানান, ঘুষ দিয়ে জালিয়াতি করে যারা সনদ নিয়েছিলেন ‘ফরেনসিক অডিটের’ মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। চলতি মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরেনসিক অডিট হাতে পেতে পারি। প্রমাণিত হলে সার্টিফিকেট বাতিল করা হবে। জাল সনদ প্রদান চক্রে জড়িত থাকায় একজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।