জাতীয় সংবাদ

উত্তরবঙ্গে তীব্র আকার ধারণ করছে শীত : পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নেমেছে ১০.৪ ডিগ্রিতে

প্রবাহ রিপোর্ট : দেশের উত্তরাঞ্চলে ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে শীত। অগ্রহায়ণের দিন যত যাচ্ছে, ততই রোদের প্রখরতা ও সূর্যের উত্তাপ ম্লান হচ্ছে। বেলা গড়িয়ে দুপুরের কিছুটা কড়া রোদ পাওয়া গেলেও বিকালের গাড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই গায়ে জড়াতে হচ্ছে গরম কাপড়। সন্ধ্যার পর গা শিহরে ওঠা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই কুয়াশাচ্ছন্ন থাকছে প্রকৃতি। ঋতু পরিবর্তনের এ সময়ে উত্তরাঞ্চলের একদিকে চলছে শীত বন্দনা। অন্যদিকে, ফ্লু, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিশেষত শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা ১০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে। এ তাপমাত্রায় জেলাটিতে কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে। গতকাল শনিবার ভোর ৬টায় জেলার প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার কার্যালয় ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। গত শুক্রবার এই জেলার তাপমাত্রা নেমেছিল ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। স্থানীয়রা জানান, পৌষ মাস না আসতেই কনকনে ঠান্ডা পড়ছে। তবে সকাল ১০টার পর থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। দিনের বেলায় বেশ গরম থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে আবার উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকলে শীত লাগতে শুরু করে। শীতের কাপড় বের করতে হয়েছে। রাত বাড়তে থাকলে শীতও বাড়তে থাকে। এদিকে, দুই দিন ধরে আকাশ পরিষ্কার থাকায় মোহনীয় সৌন্দর্য নিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে পৃথিবীর তৃতীয় ও হিমালয়ের দ্বিতীয় পর্বতমালা কাঞ্চনজঙ্ঘা। এটি দেখতে সমাগম হয়েছে শতশত পর্যটকের। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সঙ্গে শীত উপভোগ করছেন তারা। কয়েকজন পর্যটক বলেন, দারুণ সময় উপভোগ করছি। একদিকে বরফের পাহাড়, একই সঙ্গে শীত- দুটোই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। উত্তরের জেলাটি বরফের পাহাড় হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘার বিধৌত এলাকা হওয়ায় এখানে সবার আগে শীত নামে। পঞ্চগড়ের প্রথম শ্রেণির তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের সহকারী কর্মকর্তা জিতেন্দ্র নাথ বলেন, গতকাল শনিবার ভোর ৬টায় তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। গত শুক্রবার ভোর ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ১১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৌষ আর মাঘ মাসে প্রচ- ঠান্ডা পড়ে এখানে। তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে আসে। এখন দিন যত যাবে তাপমাত্রা আরও কমতে থাকবে।
রংপুরে শীতের সঙ্গে কনকনে বাতাস: রংপুর বিভাগে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। শীতের সঙ্গে বইছে কনকনে বাতাস। এতে শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েকগুণ। এদিকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই জেলায়ও ভাইরাস জ্বর, নিউমোনিয়া শ্বাসকষ্ট ও ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ বেড়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত তিন দিনে আড়াই শতাধিক মানুষ ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালের আউটডোরে আক্রান্ত রোগীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, রংপুর বিভাগে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ঘন কুয়াশার প্রকোপ বাড়তে পারে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আখতারুজ্জামান জানিয়েছেন, এবার শীতের প্রকোপ নভেম্বর মাসেই বাড়তে শুরু করেছে। শীতের কারণে শিশুরা ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসছে। বয়স্ক নারী-পুরুষরাও শীতজনিত নানান রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি শিশুদের পর্যাপ্ত শীত বস্ত্র পরানো, ভোরে আর সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে বের না করার পরামর্শ দিয়েছেন। এদিকে দিনাজপুরে গত কয়েকদিন ধরেই শীতের তীব্রতা বেড়েছে। দিন দিন তাপমাত্রা কমায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। সেই সঙ্গে ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত কুয়াশা ঝরছে। সঙ্গে হিমেল বাতাস শীতের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। শীতের কারণে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ। গতকাল শনিবার সকাল ৯টায় দিনাজপুরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর দিনাজপুরের ইনচার্জ তোফাজ্জল হোসেন জানান, দিনাজপুর অঞ্চলে দিন দিন তাপমাত্রা কমছে। গতকাল শনিবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শুক্রবার তাপমাত্রা ছিল ১৩.৮ ডিগ্রি। সকাল ৬টায় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৭ ভাগ, বাতাসের গড় গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় দুই কিলোমিটার। ভ্যানচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় হঠাৎ শীতের প্রকোপটা বেড়ে গেলো। তার সঙ্গে যে পরিমাণ কুয়াশা পড়ছে, এতে ভ্যান চালানো খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শীতের কারণে গা হাত পা জমে যাচ্ছে। জ্বর, সর্দি। কাশি ধরছে, আবার কুয়াশার কারণে সামনের কিছু দেখাও যাচ্ছে না ঠিকমতো। পথচারী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় শীতের মাত্রা একটু বেশি বোঝা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে কুয়াশা খুব পড়ছে। এতে আমাদের এই অঞ্চলে আগেভাগেই যেমন শীত পড়তে শুরু করেছে তেমনি প্রকোপটাও খুব বেশি।
রাজশাহী বিভাগে শীতের পরিস্থিতি: রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত ২৫ নভেম্বর দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় রাজশাহী অঞ্চলের নওগাঁ জেলায়। সেখানে সর্বনি¤œ ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। নওগাঁ জেলার বদলগাছি আবহাওয়া অফিসের পর্যবেক্ষক মিজানুর রহমান জানান, সামনে তাপমাত্রা আরও কমবে। অর্থাৎ রাজশাহী অঞ্চলে সর্বনি¤œ ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদের ব্যবধান কমেছে। বেড়েছে শীত অনুভূতি। ঋতু পরিবর্তনে অসুখের প্রকোপও বেড়েছে। জানা গেছে, বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে অবস্থিত মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ উপজেলার হাসপাতালেও আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগের চাপ বেড়েছে অনেক। বিশেষ করে শিশু রোগীদের প্রচুর ভিড় দেখা গেছে। এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগী আসছে রাজশাহী শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে। এতে বাড়তি ভিড় দেখা যাচ্ছে সর্বত্রই। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে হঠাৎ মানুষ সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। থাকছে মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, হাঁচির মতো লক্ষণ। কারও কারও কাঁপুনি নিয়ে জ্বর মারাত্মক আকার ধারণ করছে। শারীরিক দুর্বলতাও দেখা দিচ্ছে। ডায়রিয়াসহ অ্যাজমা রোগীরা বেশি ভুক্তভোগী বলে জানা গেছে। রোগী ও স্বজনরা বলছেন, পরিবারে একজনের জ্বর হলে তার সংস্পর্শে থাকা অন্য সদস্যরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। এমন লক্ষণ নিয়ে রাজশাহীতে ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। যেটিকে আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত শারীরিক সমস্যা হিসেবেই দেখছেন আক্রান্তরা। অনেকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েই সুস্থ হয়ে উঠছেন। আবার অনেকে জটিলতা নিয়ে জরুরি বিভাগেও ভর্তি হচ্ছেন। রাজশাহীর পবা উপজেলার বাসিন্দা শামীমা আক্তার বলেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পর্যায়ক্রমে পরিবারের চার সদস্য জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। একজন সুস্থ হওয়ার পর আরেকজন আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে আমার মেয়েটার বয়স একবছর ছয় মাস। তার বেশকিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে ভালো না হওয়ায় পরে রামেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হয়েছে। এখন আমার শাশুড়ি অসুস্থ। পরিচিত এক ডাক্তারের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন। এদিকে, শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকায় নগরীর গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজার, কোর্ট বাজার, তালাইমারি, বিনোদপুর বাজারসহ প্রধান প্রধান সড়কের মোড়ে ফুটপাতে জমে উঠেছে গরম কাপড়ের কেনাকাটাও। তবে চিকিৎসকরা বলছেন শীতের পূর্ব প্রস্তুতি শুধু গরম কাপড় পড়া নয়; পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ আরও বেশকিছু বিষয়ে সর্তক থাকতে হবে। রামেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় ফ্লু এর প্রকোপ বাড়ে। এবারও বেড়েছে। সতর্ক থাকার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের অ্যাজমা, হাঁপানি, ব্রংকিওলাইটিস ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে, তাদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। এ সময়টাই ফলমূলসহ গরম খাবার বেশি খেতে হবে। গরম কাপড় পড়তে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন ঘেমে না যায়। আর শরীরে শক্তি জোগায় এমন খাবার খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে। আর জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে হবে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শঙ্কর কে বিশ্বাস বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত সর্দি, কাশি, জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ অ্যাজমার রোগী সংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ দুই জায়গাতেই রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরা রোগীদের আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
তাপমাত্রা ওঠানামা করছে মৌলভীবাজারে: চা বাগান, হাওর ও পাহাড় বেষ্টিত জেলা মৌলভীবাজারে গত কয়েকদিন ধরেই তাপমাত্রা ১৩ থেকে ১৭ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। জেলাজুড়ে বেশি ঘন কুয়াশা লক্ষ্য করা গেছে। চা বাগান অধ্যুষিত এলাকা শ্রীমঙ্গলে তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, নানা বয়সী মানুষ সর্দি-কাশি, জ্বর নিয়ে আসেন। হাসপাতালে ভর্তি কম হলেও আউটডোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক রোগী। জেলা সিভিল সার্জন ডা. মামনুর রহমান বলেন, প্রতিদিনের মতো শীতজনিত রোগে মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে শিশু ও বয়স্ক রোগী বাড়ছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button