জাতীয় সংবাদ

তাকিয়ে দেখি সন্তানের মাথায় বাসের চাকা, স্ত্রীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাস

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে সড়ক দুর্ঘটনা

প্রবাহ রিপোর্ট : বাইকের পেছনে ছিল স্ত্রী রেশমা বেগম আর সাত বছরের সন্তান আব্দুল্লাহ। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় টাকা দেওয়ার সময় শিশু সন্তান আব্দুল্লাহ তার বাবা সুমন মিয়ার কাছে আবদার করে, ‘বাবা আমি টোলের টাকা দিবো।’ সন্তানের আবদার মেটাতে বাবা সন্তানের হাতে টাকা দেয়! ঠিক তখনই পেছন থেকে ছুটে আসা দ্রুতগতির বাস সবকিছু স্তব্ধ করে দেয়। মুহুর্তেই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হয় শিশু সন্তান আব্দুল্লাহ। চোখের সামনেই শিশু সন্তানের মৃত্যুর নির্মম দৃশ্য দেখে বাকরুদ্ধ বাবা সুমন মিয়া। কাকতালীয়ভাবে বাবা সুমন মিয়া বেঁচে গেলেও তার চোখের সামনে মারা যায় সন্তান। আর স্ত্রী রেশমা বেগম মারা যান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। স্ত্রী ও ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ সুমন মিয়া শনিবার ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে থেমে থেমে বলেন, ‘তাকিয়ে দেখি, আমার সন্তানের মাথার ওপর দিয়ে বাসের চাকা চলে গেছে। আমার সন্তানের চোখ বেরিয়ে গেছে। আর আমার স্ত্রীকে চাকার সঙ্গে বিঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘাতক বাসটি।’ অপরদিকে নিহত আমেনা বেগমের বোন জোসনা বেগম কান্নারত অবস্থায় বলেন, ‘আমার বোনের অস্তিত্ব শেষ হইয়া গেলো। আমার বোনের সঙ্গে সঙ্গে পোলাপানগুলাও মারা গেলো। আমরা কেমনে ঠিক থাকমু। মানুষ একটা শোক ভুলতে পারে না, আমরা কেমনে চারটা শোক ভুলমু!’ বিলাপ করতে করতে তিনি আরও বলেন, ‘আমেনা বলেছিল, গোপালগঞ্জ থেকে শুক্রবার সন্ধ্যার আগে ফিরবে। সে সিরাজদীখানে আমাদের বাড়িতে রাতে সবাইকে নিয়ে থাকবে। অনেক দিন পর বোন, ভাগনিদের সঙ্গে দেখা হবে ভেবে খুশি ছিলাম। কে জানতো, আমাদের খুশি এমনে শেষ হইয়া যাইবো। আমার বোন, বোনের সন্তানদের আল্লাহ এভাবে নিয়া যাইবো।’ শনিবার দুপুরে নিহত আমেনা আক্তারের বাবার বাড়ী মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের নগরকান্দা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের ভেতরে আমেনা আক্তারের মা-বোনসহ স্বজনরা স্মৃতিচারণ করতে করতে বিলাপ করছেন। আমেনা বেগমের পরিবারের লোকজনদের বিভিন্নভাবে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন অন্য স্বজনরা। মেয়ে, মেয়ের ঘরের নাতি-পুতিদের হারিয়ে বাকরুদ্ধ নিহত আমেনার মা জোবেদা খাতুন। তিনি নিস্তেজ কন্ঠে বলেন, ‘আমার মরার বয়স হয়েছে। আল্লাহ আমাকে নিলো না। ওগো সবাইরে নিয়া গেলো। আমরা কেমনে সইমু।’ কান্নারত অবস্থায় আমেনার বোড় বোন মিলন বেগম বলেন, ‘আমার বোন-ভাগনিদের হত্যাকারী বাসের ভিডিওটি দেখেছি, কিভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। টোলপ্লাজা সবচাইতে নিরাপদ জায়গা। অথচ সেখানে এমন ঘটনা! ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের মারা হয়েছে।’ টোলপ্লাজার সিসিটিভিতে দুর্ঘটনার ভিডিওটি ধরা পরেছে। তাতে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজার মাওয়ামুখী লেনে একটি মোটরসাইকেল টোল পরিশোধের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। তার পেছনে একটি মাইক্রোবাস দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় আরও একটি প্রাইভেটকার। অল্প কিছুক্ষণ পরেই বেপরোয়া গতিতে বেপারী পরিবহনের একটি বাস দ্রুত টোলপ্লাজার দিকে আসতে থাকে। টোলপ্লাজার সামনে আসলে বাসের গতি আরও বেড়ে যায়। সেসময় বাসটি প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেলকে সজোড়ে ধাক্কা দিয়ে দুমড়ে-মুচড়ে টোল প্লাজার বাইরে নিয়ে চলে যায় ঘাতক বাসটি। শনিবার নিহত আমেনা বেগমের ঘরে বাইরে চেয়ারে মধ্যে বসেছিলেন আমেনার বাকরুদ্ধ স্বামী ইকবাল হোসেন, ছোট ভাই মো. ইয়াকুব, বড় বোন জামাই মো. আইয়ুব খান ও দেবর মো. জাহাঙ্গীর আলম। সবাই আমেনার স্বামী ইকবালকে ঘিরে বসেছিলেন। সে সময় ইকবালের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও নাতিরে বাস চাপা দিয়ে খুন করা হইছে। আমার মেজ মেয়ে অনামিকার অবস্থাও খুব খারাপ। কারা, কেনো ওদের খুন করলো। ইকবাল বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর সব জায়গায় সংস্কার হচ্ছে। সড়কে কোনো সংস্কার নেই। প্রতিদিনই মানুষ মরছে। এ ব্যাপারে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি সব হারাইছি। আর কেউ যেনো কারও একজনও আপনজন না হারায়। আমি সরকারসহ সবার কাছে আমার স্ত্রী, সন্তান ও নাতি হত্যার বিচারসহ সড়কপথ নিরাপদ করার দাবি জানাই। নিহত আমেনা বেগমের দেবর জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, বাসচাপা দেওয়ার ঘটনাটি পরিকল্পিত। বাসটি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাকে, তাহলে যাত্রীদের বাঁচাতে টোলপ্লাজার অন্য কোথাও মেরে দিতে পারত অথবা টোলপ্লাজার অন্য লেনে গাড়ি ছিল না সেখান দিয়ে যেতে পারতো। তিনি বলেন, টোলপ্লাজায় আসলে বাসের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু টোলপ্লাজার দিকে আসার পর, বাসের গতি এতো বাড়ল কেনো। বাসটি থেমে থাকা গাড়িগুলোর ওপরেই কেনো উঠিয়ে দিতে হলো। আমরা বিভাগীয় তদন্তসহ ব্যবস্থা চাই।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button