বদলির প্রতিবাদে চাকরি ছাড়লেন খুমেকে জ্যেষ্ঠ দুই চিকিৎসক

স্টাফ রিপোর্টার ঃ খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে অধ্যাপক পদমর্যাদার দুই চিকিৎসককে হঠাৎ ২৯ ডিসেম্বরে দিনাজপুরে বদলি করা হয়েছে। তারা হলেন, খুলনা মেডিকেল কলেজ মানসিক বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. এসএম ফরিদুজ্জামান এবং নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা: মো: কামরুজ্জামান। প্রতিবাদে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন এ দুই জ্যেষ্ঠ চিকিসক। আর এতে ফুঁসে উঠেছেন চিকিৎসকরা। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে অন্যান্য চিকিৎসকের মাঝে। তারা স্যোশাল মিডিয়া ফেসবুকেও প্রতিবাদে ঝড় তুলেছেন। আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে বিবৃতি দিয়েছে খুলনা বিএমএ। নির্বাচনের ঠিক আগে এমন পরিস্থিতিতে উত্তপ্ত অবস্থায় খুলনার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে হঠাৎ ২৯ ডিসেম্বরে মানসিক বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা: এসএম ফরিদুজ্জামানকে দিনাজপুরে আব্দুর রহীম মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। এর ঠিক দুই দিন পরে নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা: মো: কামরুজ্জামানকেও আব্দুর রহীম মেডিকেল কলেজে বদলি করা হয়। বদলি আদেশে বলা হয়, তিন দিনের মধ্যে যোগদান না করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ অবমুক্ত এবং যোগদানে অবহেলা করলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় বদলি আদেশে। এর প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার ওই দুই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক চাকরি ছেড়ে দেন। জ্যেষ্ঠ এ দুই চিকিৎসকের বদলি আদেশ পুনর্বিবেচনা করতে লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন খুলনা বিএমএ সভাপতি ডা: শেখ বাহারুল আলম এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা: মেহেদী নেওয়াজ। প্রচার সম্পাদক ডা: সাইফুল্লাহ মানসুরের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে অন্যান্যরা হলেন- সহ সভাপতি ডা. মনজুর মোরশেদ, ডা: সামসুল আহসান মাসুম ও ডা.: মোল্লা হারুন, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা: মো: কুতুব উদ্দিন মল্লিক, যুগ্ম সম্পাদক ডা: নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক ডা: সুমন রায় প্রমুখ। এ ছাড়া বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার সকাল থেকে খুলনার বেশিরভাগ চিকিৎসক তাদের ফেসবুক পেজে নিন্দার ঝড় তুলেছে। তারা দাবি করেছেন, তাদের এ দুই প্রতিথযশা শিক্ষকের সাথে অন্যায় এবং অবিচার করা হয়েছে। এতে নিন্দা জানান খুলনার মানুষের পাশাপাশি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী ও উচ্চতর কোর্সের প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেন, ২০২৩ সালে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার দিন আলাদা দুটি হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন ডা. কামরুজ্জামান এবং ডা. ফরিদুজ্জামান। তখন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে খুলনা মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করেন একজন উপসচিব। সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্ন পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া নিয়ে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় উপসচিব এবং ওই দুই চিকিৎসকের মধ্যে। পরীক্ষার পর মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ তদন্ত কমিটিতেও এই দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে এতদিন কোনো কিছু না হলেও আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সভায় বিষয়টি আবার সামনে এলে হঠাৎ করে তাদের বদলি করা হলো।
খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা: মো: দ্বীন-উল ইসলাম শুক্রবার রাতে এ প্রতিবেদককে বলেন, মন্ত্রনালয় থেকে জনস্বার্থে দুইজন শিক্ষককে বদলী করা হয়েছে। কি কারণে পরবর্তীতে তারা চাকরি থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারি চাকুরি বিধি নিয়ম অনুসারে কর্মস্থলে কেউ এক জায়গায় ৩ বছরের বেশি থাকলে তাদেরকে যে কোন সময়ে বদলী করার নিয়ম আছে। তিনি বলেন, বদলীর হওয়া দুই শিক্ষক চাকরির বয়স ২৭ বছর হয়ে গেছে। তাদের বদলী দুরে হওয়া এবং তাদের বয়স হওয়ার কারণে তারা দুইজনই স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা: মেহেদী নেওয়াজ বলেন, আমরা এ বিষয়ে নির্বাচনের পর আগামী ৯ জানুয়ারি দুপুরে বিএমএ এর পক্ষ থেকে একটি জরুরি ইসি মিটিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
খুলনা বিএমএ সভাপতি ডা: শেখ বাহারুল আলম বলেন, এই বিষয় নিয়ে আমরা একটি বিবৃতি দিয়েছি। এছাড়া আমরা নির্বাচনের পর এ বিষয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে সভা করে মন্ত্রণালয়ে অবহিত কররা উদ্যোগ নিয়েছে। খুলনা বিএমএ সভাপতি ডা: শেখ বাহারুল আলম তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো, ‘সচিবালয়ের দাপটে খুমেকের দুই অধ্যাপক তাৎক্ষণিক বদলি হল ’ শিরোনাম দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন চারিদিকে যখন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা ও নির্বাচন কমিশন উত্তাপ ছড়াচ্ছে তখন এই উত্তাপে উত্তপ্ত সচিবালয় খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হাজারো সমস্যা উপেক্ষা করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে স্বাস্থ্যসচিব দুই অধ্যাপককে বদলী ও ৩ কর্মদিবসের মধ্যে অব্যাহতি দিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের বাহাদুরির এক নজির সৃষ্টি করল। অথচ নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশন ব্যতিরেকে অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের বদলি করা নিষেধ। আমলাতন্ত্রের এ ভয়ঙ্কর রূপ স্বাস্থ্যমন্ত্রী নীরবে অবলোকন করেছে, তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। অভিভাবকের চেয়ারে বসে তার জানা থাকার কথা মফঃস্বলের এসব অধ্যাপকের সাথে জড়িত থাকে – চিকিৎসা শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারাদেশে চিকিৎসা শিক্ষক সংকট তীব্র, খুমেকেও শিক্ষক সংকট বিরাজ করছে । চিকিৎসা শিক্ষক সংকট উপেক্ষিত হয়ে অনেক বড় হয়ে দেখা দিল আমলাতন্ত্রের ক্ষোভের বিষয়টি , যার বহিঃপ্রকাশ ঘটল দুই অধ্যাপক শিক্ষক বদলি করে। মন্ত্রী বাধা দিতে পারত কিন্তু দেওয়ার সদিচ্ছা তার নাই । বাংলাদেশের অবহেলিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এসব অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে থেকে সুন্দরবন উপকূলীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আস্থাশীল চিকিৎসা পেয়ে আসছিল। এর সাথে যুক্ত আছে যে সকল চিকিৎসকদের বিএসএমএমইউ- কোর্স এ পাঠিয়েছে, তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যাহত হবে। ক্ষোভের উন্মাদনায় স্বাস্থ্যসচিব এসব প্রেক্ষাপট আমলে নেয়নি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চিকিৎসা না পেলে মন্ত্রী- সচিবের কিছু যায় আসে না। তাদের সকল দৃষ্টি রাজধানীর দিকে। মফঃস্বলের চিকিৎসা শিক্ষা ও হাসপাতাল কিভাবে চলে- এ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নাই । নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করলেও তাদের টনক নড়ে না । মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে কবে কখন উপসচিবের সাথে দুই অধ্যাপকের বাকবিতন্ডা হয়েছে , যা পরবর্তী তদন্তে অধ্যাপকরা সঠিক ছিল এটি প্রমাণিত হওয়ার পরেও ক্ষমতাবান সচিবালয়ের ক্ষোভ প্রশমন হয়নি । যে কারণে ক্ষোভের এ খড়গ নেমে এসেছে খুলনা মেডিকেল কলেজের উপর । কাপুরুষের মত নিয়মতান্ত্রিক বদলির অজুহাত দেখানো হচ্ছে অথচ খুলনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যে সকল শূন্য পদ আছে , রাজধানী থেকে নিয়মতান্ত্রিক বদলি করে এসকল শূন্যপদ পূরণের সদিচ্ছা ও সামর্থ্য তাদের কোথায়? যত ক্ষমতা প্রদর্শন সবই মফঃস্বলের উপর। মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়া উপসচিবের অপরাধ। কারণ রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় অধ্যাপকরা উপসচিবের অনেক উপরে । অপরাধ কার , শাস্তি ভোগ করে কে ? পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাই কিছু মানুষের হাতে জিম্মি, তাদের ইচ্ছাই আইন ! রাজনীতি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এদের প্রশ্রয় দেয় ও সমর্থন করে। আমরা চিকিৎসকরা সেই রাজনীতির পদলেহন করি এই আমার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ! ’