জাতীয় সংবাদ

ভাড়া নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে নৌপথে পণ্য পরিবহন

প্রবাহ রিপোর্ট : বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে নৌপথে পণ্য পরিবহন। দেশের অভ্যন্তরীণ নৌরুটে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে ভাড়া নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে জাহাজ মালিকদের দু’পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। আর এ বিবাদে শ্রমিকরাও জড়িয়ে পড়ছে। জাহাজ মালিকদের এক পক্ষ চায় জাহাজ চলাচলে পুনরায় সিরিয়াল পদ্ধতি চালু হোক। আর অন্য পক্ষ চায় ব্যবসায়ীরা দরকষাকষি করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে নিজেরাই ভাড়া ঠিক করুক। প্রতিযোগিতামূলক দরে পণ্য পরিবহনের সুযোগ পেতে উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা এখন সমর্থন করছে দ্বিতীয় পক্ষকেই। ব্যবসায়ী ও জাহাজ মালিকদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বছরে প্রায় ১০ কোটি টন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে হ্যান্ডলিং হয়। আমদানীকৃত ভোগ্যপণ্য, সিমেন্ট তৈরির কাঁচামালসহ নানা শিল্পপণ্য মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজে (ছোট জাহাজ) স্থানান্তর করে অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটে পরিবহন করা হয়। দুই দশক ধরে চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের নানা গন্তব্যে লাইটার জাহাজ পরিচালনা করে আসছে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল বা ডব্লিউটিসি। কিন্তু ওই সেল ভেঙে যাওয়ার পর থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই জাহাজ ভাড়া কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাসহ নানা গন্তব্যে নৌপথে পণ্য পরিবহন খরচ ২০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। এখন নতুন এক নীতিমালাকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। গত ১৫ অক্টোবর প্রণীত ওই নীতিমালায় লাইটার জাহাজের সিরিয়ালভুক্তি, বরাদ্দ ও জাহাজের ভাড়া নির্ধারণের একক দায়িত্ব বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলকে (বিডব্লিউটিসিসি) ন্যস্ত করা হয়েছে। নতুন নীতিমালা অনুসারে, নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের সুপারভাইজরি কমিটি এ সেলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। নীতিমালার শর্ত অনুযায়ী বিডব্লিউটিসিসির বরাদ্দ ছাড়া কোনো লাইটার জাহাজ বাংলাদেশের কোনো সমুদ্রবন্দরে আসা মাদার ভেসেল (বড় জাহাজ) থেকে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত থাকতে পারবে না। তবে কিছু শর্তসাপেক্ষে, যেসব ফ্যাক্টরি ও গ্রুপ অব কোম্পানির নিজস্ব লাইটার জাহাজ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অব্যাহতিপত্র পাওয়া সাপেক্ষে নিজস্ব জাহাজে পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা ভাড়া করা জাহাজ দিয়ে তাদের বহর বাড়াতে পারবেন না অথবা তাদের বহরে থাকা কিন্তু কারখানার নামে নিবন্ধিত নয় এমন জাহাজে পণ্য পরিবহন করতে পারবেন না। সূত্র জানায়, নতুন ঘোষিত বেসরকারি ওই সেল জাহাজ বরাদ্দের নির্ধারিত কার্যক্রম চট্টগ্রামের লাইটার জাহাজ মালিকদের সংগঠনের বিরোধিতার কারণে শুরুই করতে পারেনি। আমদানিকারক ব্যবসায়ীরাও ওই নীতিমালার বিরোধিতা করেছেন। ব্যবসায়ীদের মতে, যেসব জাহাজ মালিকদের একটি পক্ষ আগের মতো নদীপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতো, তারা এখনো তা বহাল রাখতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই নীতিমালার কারণে আমদানি হওয়া পণ্য নৌপথে পরিবহনে প্রতিযোগিতামূলক দর থেকে ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হবেন। জাহাজের সিরিয়াল ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে এককভাবে একটি সংগঠনকে কর্তৃত্ব দেয়ার অর্থ হলো পুরনো সিন্ডিকেশন ফিরিয়ে আনা। জাহাজ মালিকদের এ বিরোধে এখন জড়িয়ে পড়ছে শ্রমিকরাও। সিরিয়াল প্রথা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে শ্রমিক সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সূত্র আরো জানায়, প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ায় সময়মতো পণ্য হাতে পাওয়ার অধিকার নিশ্চয়ই ব্যবসায়ীদের রয়েছে। এছাড়া এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি ভোক্তার স্বার্থও জড়িত। তাই আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকদের দরকষাকষির ভিত্তিতে জাহাজের ভাড়া নির্ধারণ হওয়াটাই যৌক্তিক পথ। কোনো একটা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চাপিয়ে দেয়ার ফর্মুলাটি পণ্য পরিবহন ব্যয়কে বাড়িয়ে দেবে, যেটি কোনো ব্যবসাবান্ধব পদক্ষেপ হতে পারে না। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের প্রায় অর্ধেকই খোলা পণ্যবাহী (বাল্ক)। বাল্ক ক্যারিয়ারে আসা চাল, ডাল, গম, ছোলা, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা, পাথর, স্ক্র্যাপসহ নানান পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে ১ হাজার ৮০০-এরও বেশি লাইটারেজ জাহাজ। একসময় নদীপথে ওসব নৌযানে পণ্য পরিবহনের পুরো প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণ করতো বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি)। কিন্তু দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ এনে একপর্যায়ে জাহাজ মালিকদের একটি পক্ষ ওই সংস্থা থেকে বেরিয়ে আলাদাভাবে পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম শুরু করে। এদিকে আমদানীকারকদের মতে, শুরুতে আমদানীকারকরা বড় পরিসরে লাইটারেজ মালিকদের সঙ্গে কার্গো পরিবহনে চুক্তিবদ্ধ হতো। পরিবহনের চাহিদা আরো বাড়তে থাকলে ডব্লিউটিসি গঠন করে আমদানিকারকদের এক প্রকার জিম্মি করে ফেলা হয়। তারা বাই রোটেশনে জাহাজ দিত। সময়মতো লাইটার না পেয়ে একেকটা মাদার ভেসেলে ডেমারেজই চলে আসত ৫-১০ লাখ ডলার। একপর্যায়ে তো লাইটার জাহাজ বরাদ্দ পেতে কমিশন বাণিজ্য পর্যন্ত শুরু করা হলো। ওয়ান-ইলেভেনের সময় কিন্তু আবার ট্রান্সপারেন্ট ওয়েতে লাইটার জাহাজ ডিস্ট্রিবিউট হচ্ছিল, যেটা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকারের আমল থেকে আবার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বড় আমদানিকারকরা বিশেষ করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী ও সিমেন্ট কোম্পানিগুলো এতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই সরকারের অনুমতি নিয়ে লাইটার জাহাজ তৈরি করে নিজেদের পণ্য পরিবহনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আমদানি ভলিউম বাড়ায় এখনো জাহাজ ভাড়া করতে হয়। আগে বহির্নোঙর থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ভাড়া নিত প্রতি টনে ৬৬২ টাকা। সেটি কমে এখন প্রতি টন ৫৪০ টাকায় পরিবহন করা যাচ্ছে। এ সাশ্রয়ের সরাসরি সুফলভোগী ভোক্তা শ্রেণী। ব্যবসায়ীরা চায়- চাই নদীপথে পণ্য পরিবহনে সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসাকে বাধাগ্রস্ত যেন না করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাইটার জাহাজযোগে পণ্য পরিবহনে ২০২৩ সালে ভেঙে দেয়ার পর নৌ-রুটে পণ্য পরিবহনে ২০ শতাংশেরও বেশি পরিবহন ব্যয় কমে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরগুলোয় পণ্য পরিবহন নিয়ে নতুন নীতিমালায় এ ব্যয় আবারো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে আমদানিকারক ও জাহাজ মালিকের পছন্দ এবং দরকষাকষির ভিত্তিতে জাহাজ ভাড়া নির্ধারণই সমর্থনযোগ্য। অন্যদিকে জাহাজ মালিকদের যে সংগঠনটি প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণের পক্ষে সেটি ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) নামে পরিচিত। সংগঠনটির মুখপাত্র পারভেজ আহমেদ জানান, লাইটার জাহাজে পণ্য পরিবহনে মূল ভূমিকা রাখে পণ্যের আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা। গত বছর বিলুপ্ত হওয়া ডব্লিউটিসি ভিন্নভাবে পুনরায় চালু করার পদক্ষেপ দেশের ব্যবসায়ীরাও সমর্থন করছে না। এ স্টেকহোল্ডারের কোনো মতামত ছাড়াই আগের মতো নীতিমালা প্রণয়ন কতটা যৌক্তিক তা প্রশ্নসাপেক্ষ। দেশের লাইটার জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের নির্বাচিত কার্যকর পরিষদের প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছিল ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল। লাইটার জাহাজ মালিকদের বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিসিভোয়া), কোস্টাল ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন (কোয়াব) এবং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব চিটাগাং (আইভোয়াক) নামের তিনটি সংগঠনের সদস্যদের মালিকানাধীন জাহাজগুলো বন্দরের বহির্নোঙর থেকে পণ্য পরিবহন করে থাকে। ডব্লিউটিসি অভ্যন্তরীণ নৌ-রুটে লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে এলেও অভ্যন্তরীণ বিরোধে ডব্লিউটিসি থেকে আইভোয়াক বের হয়ে আলাদা সেল গঠন করে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button