বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা : ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড

# ৫ জনের যাবজ্জীবন বহাল #
প্রবাহ রিপোর্ট : সাড়ে পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবনের রায় বহাল রেখেছে হাই কোর্ট। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে গতকাল রোববার এ রায় দেয় বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আপিল বেঞ্চ। রায় ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদ- এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন বহাল রেখেছে। এদের মধ্যে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ৪ জন পলাতক রয়েছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি বলেন, নি¤œ আদালত যে ফাইন্ডিংস দিয়েছে, এখানে ইন্টারফেয়ারের মতো কিছু নেই। আসাদুজ্জামান বলেন, এর আপিল ফাইল হবে। ডেথ রেফারেন্সের আপিলে সিপি ফাইল করতে হবে না; এটা মেটার অব রাইট। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমার পাশে আবরারের বাবা আছেন, উনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন, গোটা জাতি ন্যায়বিচার পেয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে ডিসিপ্লিন আনার জন্য, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের যে ধারণা, সে ধারণাটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ রায়ের মধ্য দিয়ে সমাজে বার্তা গেল যে- আপনি যত শক্তিশালী হোন না কেন, আপনার পেছনে যত শক্তি থাকুক না কেন- সত্য এবং ন্যায়বিচার একদিন প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, মাও সেতুংয়ের মতে, কোনো কোনো মৃত্যু হয়- পাহাড়ের মতো ভারী, আর কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা। আবরারের মৃত্যু আমাদের কাছে পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে আছে। গোটা জাতির মূল্যবোধের শিকড়ে নাড়া দিয়েছে। আবরার ফাহাদের মৃত্যু এক্সপোজ করেছে যে রাজনৈতিক ফ্যাসিজম কীভাবে দিনে দিনে বাড়তে পারে। একই সাথে আবরারের মৃত্যু আমাদেরকে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেছে যে- ফ্যাসিজম যত শক্তিশালী হোক, মানুষের মনুষ্যত্ববোধ কখনো কখনো জেগে উঠবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবরার ফাহাদ তার জীবন দিয়ে অসংখ্য মেধাবী ছাত্রের জীবন রক্ষা করে দিয়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়ার কারণে আবরার ফাহাদের বিচার নিশ্চিত হয়েছে। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ছেলেমেয়েরা যদি বিভিন্ন প্রলোভনে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাবা-মা কষ্ট পেয়ে থাকে। ছাত্রদের কাছে আবেদন থাকবে তারা যেন এসব খারাপ রাজনীতিতে জড়িত না হয়। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট। ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি। ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলা বিচারে এসেছিল। দুই পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় আসে, যাতে ২০ জনের মৃত্যুদ- এবং পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। তাদের মধ্যে তিনজন মামলার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। বাকি ২২ জনের মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত মুনতাসির আল জেমির কারাগার থেকে পালিয়েছেন। গণঅভ্যুত্থানে সরকারপতনের পর গত ৬ অগাস্ট তিনি গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে পালিয়ে যান। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বুয়েটে বিক্ষোভ দেখান কয়েকশ শিক্ষার্থী।
সন্দেহ থেকে পিটিয়ে হত্যা
আবরার ছিলেন বুয়েটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। মামলার আসামিদের সবাই বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে আটজন আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আবরারকে কীভাবে ক্রিকেট স্টাম্প আর স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল, সেই ভয়ঙ্কর বিবরণ উঠে আসে তাদের জবানবন্দিতে। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায় কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আবরার ফেইসবুকে তার শেষ পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই যে ফেইসবুক পোস্টের সূত্র ধরে ‘শিবির সন্দেহে’ আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা সংগঠনটির তদন্তে উঠে এলে ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়। আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। আবরারকে যে রাতে হত্যা করা হয়, তার পরদিন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। পাঁচ সপ্তাহ তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ওইবছর ১৩ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেখানে আসামি করা হয় মোট ২৫ জনকে। অভিযোগপত্র গ্রহণ করে গত ১৮ নভেম্বর পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তাদের মধ্যে একজন পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে মামলাটি পরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তর করে আদেশ জারি হয়। বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এ মামলার বাদী ও আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ ২০২০ সালের ৫ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। কারাগারে থাকা ২২ আসামি গত ১৪ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তিন আসামি পলাতক থাকায় তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি। এরপর কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এ মামলার চার্জ গঠনের সময় শব্দগত ত্রুটি থাকায় ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ তা সংশোধনের আবেদন করে। পরদিন ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ গঠন করে আদালত। আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর দুইপক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেওয়া হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাই কোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। এরপর আসামিরা দ- থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদ- দেওয়া হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। দ-িত আসামিরা উচ্চ আদালতে ফৌজদারি আপিল এবং জেল আপিল করতে পারেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি দ্রুত শুরুর উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। এরপর শুনানি শেষে গতকাল রোববার আপিলের রায় ঘোষণা করা হলো।