সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যশিক্ষার সংকট: মেডিকেল কলেজ নাকি মৃত্যুফাঁদ?

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যশিক্ষার অব্যবস্থাপনা আজ চরম সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক তদবির ও লোভের কারণে ৫২টি নতুন মেডিকেল কলেজ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৩২টি বেসরকারি এবং ২০টি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই মানহীন এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। বিশেষ করে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ক্ষেত্রে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি করানো হলেও শিক্ষার মান বজায় রাখা হয়নি। অধিকাংশ কলেজে ল্যাব, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এবং দক্ষ শিক্ষক নেই। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া চিকিৎসকরা বাস্তবে রোগীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছেন। রাজশাহীর শাহ মখদুম মেডিকেল কলেজ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ২০১৩ সালে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুমোদন পাওয়া এই কলেজটি ছিল কেবল সাইনবোর্ড সর্বস্ব। বিএমডিসি’র অনুমোদন ছাড়াই শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে তাদের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অনিয়মের কারণে শাহ মখদুমসহ কয়েকটি মানহীন মেডিকেল কলেজ ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হলেও, এখনো বহু প্রতিষ্ঠান একই রকম অরাজক অবস্থায় চলমান। বিগত সময়ে মন্ত্রী, এমপি ও ব্যবসায়ীদের তদবিরে অনুমোদন পাওয়া এসব মেডিকেল কলেজ বাস্তবিকভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন স্বীকার করেছেন যে, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদনপ্রাপ্ত অনেক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় মানদ- পূরণ করেনি এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থাও হতাশাজনক। নেত্রকোণা, চাঁদপুর, নওগাঁ, নীলফামারী, মাগুরা এবং হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অব্যবস্থাপনার শিকার। অপরদিকে, ঢাকার আইচি মেডিকেল কলেজ, কেয়ার মেডিকেল কলেজসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেক মানহীন প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় টিকে আছে। দেশে প্রতিবছর ১১,০০০ চিকিৎসক পেশায় যুক্ত হন, কিন্তু তাদের মধ্যে কতজন প্রকৃত অর্থে দক্ষ, সেটি নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায়। নি¤œমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা চিকিৎসকদের সনদের মূল্য চাকরির বাজারেও পড়ে গেছে, যা প্রমাণ করে যে এই সিস্টেম নিজেই নিজের অসারতা দেখিয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, এই মানহীন শিক্ষা ও চিকিৎসার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের, যারা ভুল চিকিৎসায় অঙ্গহানি বা জীবনহানির শিকার হচ্ছেন। এখন সময় এসেছে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেছেন, ‘জরুরি শর্তগুলো ছাড় দিয়ে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া বড় ধরনের অপরাধ, যা এখনই সংশোধন করতে হবে।’ সরকারকে এখন নীতিগতভাবে কঠোর হতে হবে এবং স্বাস্থ্যশিক্ষার মানোন্নয়নে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা, দেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হবে, যা জনগণের জন্য চরম বিপর্যয় বয়ে আনবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button