স্থানীয় সংবাদ

নগরীতে চিলড্রেনস ভয়েস স্কুলে শিক্ষার নামে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা

# প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীরের অপসারনের দাবিতে অভিভাবকদের মানববন্ধন
# নগ্ন ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী
# টেলিভিশনে সংবাদ প্রচারের জের ধরে স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষককে বাড়িতে ডেকে মারপিট
# শিক্ষা বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই চলছে মাধ্যমিকের পাঠদান জালিয়াতির মাধ্যমে বই সংগ্রহ ও কেজি দরে বিক্রি
# স্কুল ভবনে রমরমা কোচিং ব্যবসা

মুশফিকুর রহমান মেহেদী ঃ দীর্ঘ ১৭ বছর শিক্ষাখাতকে পঙ্গু করে রেখেছিল সাবেক সরকার। ৫ ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলমান রয়েছে ফ্যাসিস্টের নিয়ম। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনরকম নিয়ম নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই যেন খুলে বসেছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খ্যাত খুলনা চিলড্রেন’স ভয়েস মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার নামে উঠেছে ভয়াবহ প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগ । সম্প্রতি স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের নগ্ন ভিডিও রাতারাতি ভাইরাল হওয়ায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। তথ্য রয়েছে স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন নারীকে এসব ভিডিও পাঠাতেন তিনি। সম্প্রতি কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের সংবাদ প্রচার হয়। ফলে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে নেটদুনিয়া। এই ঘটনার জের ধরে গত ৪ মে রবিবার স্কুলের সাবেক শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমানকে বাড়িতে ডেকে মারপিট করে জাহাঙ্গীর। খুলনার এচ্চলিক আঞ্চলিক পত্রিকার নারী সম্পাদক কৌশলে বাড়িতে ডেকে জাহাঙ্গীরকে সহযোগীতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায় ।এ বিষয়ে ভুক্তভোগী মোস্তাফিজ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।এসকল ঘটনা জানাজানি হলে আজ ৫ মে দুপুর ১২ টায় জাহাঙ্গীরের অপসারণের দাবীতে মানববন্ধন করেন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকা ও অভিভাবকগন ।খুলনা সোনাডাঙ্গার বয়রা বাজার সংলগ্ন স্কুলটি ২০০৫ সাল থেকে প্রাথমিক কিন্ডার গার্ডেন ও ২০১২ সাল থেকে মাধ্যমিক শাখার পাঠদান করে আসছে। প্রাথমিক শাখার দায়িত্বে রোকেয়া সিদ্দিকা ও মাধ্যমিক শাখার দায়িত্ব রয়েছেন মো: জাহাঙ্গীর ইসলাম। মাধ্যমিক শাখা তথা ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর‌্যন্ত যে সকল শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের সাথেই করা হচ্ছে মূল প্রতারণা। পাঠদানের কোন অনুমতি না থাকলেও উচ্চ হারে নেওয়া হচ্ছে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন। শিক্ষা বিভাগের নিয়ম অনুযায়ী, অনিবন্ধিত বা অনুমোদনহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠদান করতে হবে। তবে সেটা অবশ্যই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণকে অবগত করতে হবে। চিলড্রেনস ভয়েস মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রে ঘটনা একদমই উল্টো। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর‌্যন্ত বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীগন জানেন না, স্কুলটি টেক্সটাইল জুট মিলস স্কুলের অধীনে। মাধ্যমিক শিক্ষার কার‌্যক্রম চিলড্রেনস ভয়েস স্কুলে চললেও, মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট ও তথ্য ব্যবহার করছে টেক্সটাইল মিলস স্কুলের। এ বিষয় নিয়ে ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী তাহসিনা হুসাইন এর অভিভাবক জেসমিন হোসেন জানান, টেক্সটাইল মিলস স্কুলের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। আমার মেয়ে চিলড্রেনস ভয়েস স্কুলে পড়ে। সার্টিফিকেট ও ওই স্কুল থেকেই পাবে। একই শ্রেণীর আফিফ ইসলামের অভিভাবকও পুরোপুরি জানেন না এঘটনা। এছাড়া অনিবন্ধিত এই প্রতিষ্ঠানের নিজ নামে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে বই গ্রহণ করছে । বিশেষ সূত্রে জানা যায়, স্কুলটি চাহিদার অতিরিক্ত বই নিয়ে, পরবর্তীতে বেশি দামে শিক্ষার্থীদের নিকট বিক্রি করে। এছাড়া গোডাউনে অসংখ্য বই জমা থাকে। আর সেখান থেকেই কেজি দরে বই, বাইরে বিক্রি করার তথ্য পাওয়া গেছে । এছাড়া শিক্ষার্থীদের নিকট চড়ামুল্যে বই বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, কদিন দেরীতে ভর্তি হলেই বেশি দাম দিয়ে বই কিনতে হয়।
এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং ব্যবসা পরিচালনার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে জমজমাট চলছে এ কার‌্যক্রম । পূর্বে এই প্রতিষ্ঠানে বিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে কোচিং চালানো হতো। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় নাম পরিবর্তন করে একই ভবনে কোচিং চালাচ্ছেন জাহাঙ্গীর ইসলাম। এছাড়া কোচিং পরিচালনার জন্য শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে উচ্চ হারে বেতন গ্রহণ করা হয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোচিং না করলে সে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে হয়রানি করা হয় বলে জানা গেছে। এদিকে স্কুলটির বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবিভাগের মহাপরিচালকের নিকট লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে । সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চিলড্রেনস ভয়েস স্কুলটি যৌথ মালিকানা হওয়া সত্ত্বেও জোরপূর্বক ভাবে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী চালানো হয়। যৌথ মালিকানা হওয়া সত্বেও অপর মালিকের স্বাক্ষর জাল করে ভাড়ার চুক্তিপত্র তৈরি করেন জাহাঙ্গীর। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, স্কুলটি অনিবন্ধিত হওয়া সত্ত্বেও লোভনীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দাবি করা হয় বাড়তি টাকা । স্কুলটির মাধ্যমিক শাখার নিজস্ব কোন জমি বা ভবন নেই। সাবেক সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যক্তিদেরকে স্কুলে আমন্ত্রণ করে মাধ্যমিক শাখার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বিদ্যালয়টি পরিচালনা করার জন্য নিয়ম তান্ত্রিক গভর্নিং বডি নাই। শিক্ষার্থীদের উচ্চ হারে বেতন নেওয়া হলেও বেশিরভাগ শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। শিক্ষকদের নিয়োগ পত্র বানিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেয় মাধ্যমিক শাখার প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন। শিক্ষকদের ইচ্ছামত চাকুরিচ্যুত করা হয়। চাকুরীচ্যুত করার পূর্বে কোনরকম কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয় না। স্কুলে কর্মরত একজন শিক্ষক জানান, প্রধান শিক্ষক নিজের ইচ্ছা মত সবকিছু করে।শিক্ষিকাদেরকে নোংরা ছবি পাঠিয়ে নানা কু- প্রস্তাব দেন তিনি। রাজি না হলে কিংবা তার মতের বাইরে গেলেই নানা অপবাদ দিয়ে চাকুরীচ্যুত করতেন তিনি। এদিকে স্কুলটির সরকারি নিবন্ধন করার নাম করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত ফি ছাড়া অতিরিক্ত ফি গ্রহণ করা হয়। এ সকল অভিযোগের বিষয়ে স্কুলটির সহকারী প্রধান শিক্ষিকা রোকেয়া সিদ্দিকা বলেন, জাহাঙ্গীর ইসলাম আমার স্বাক্ষর জাল করে স্কুলের নামে নানা অনিয়ম করেছে।ইতিমধ্যে আমি একটি মামলা দায়ের করেছি। তবে এ সকল বিষয় সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা বলে এড়িয়ে যান জাহাঙ্গীর ইসলাম। ধরা বাধা উত্তর দিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা রেজিস্ট্রেশনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়গুলো এড়িয়ে যান।
তবে অভিযোগের সত্যতা পেলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সাবেক জেলা শিক্ষা অফিসার মোহাম্মদ শামসুল হক। তিনি বলেন, চিলড্রেনস ভয়েজ স্কুলের বিরুদ্ধে আমরা বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য ও প্রমাণ পেলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button