জাতীয় সংবাদ

৫ আগস্টের পর বাথরুমে লুকিয়ে ছিলেন ওবায়দুল কাদের

দ্য ওয়ালকে ওবায়দুল কাদের

প্রবাহ রিপোর্ট : আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা ওয়ায়দুল কাদের। দলের তিনবারের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সেতু মন্ত্রী ৭৩ বছর বয়সী এই নেতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবর পরিচিত, আলোচিত, বিতর্কিত, সমালোচিত। মুক্তিযোদ্ধা, দাপুটে ছাত্র নেতা থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের আওয়ামী লীগের উত্থানপতনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। শেখ হাসিনার ¯েœহধন্য কাদের দলের সঙ্কটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। একইসাথে ‘হিরো’ ও ‘ভিলেন’ ভাবমূর্তি বয়ে বেড়ানো ওই নেতা বড় সঙ্কটের মুখোমুখি হন গত বছরের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে দলে। ২০১৪-এর ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫-এর ২৫ মে, বিগত ১০ মাস অন্তরালে থাকা ওবায়দুল কাদের প্রথম মুখ খুলেছেন দ্য ওয়াল-এর কাছে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ঘটনা থেকে তাকে নিয়ে সমালোচনার জবাব অকপটে দ্য ওয়ালকে বলেছেন এই নেতা। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্য ওয়াল-এর এক্সিকিউটভ এডিটর অমল সরকার।
পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম
‘গণঅভ্যুত্থানের দিন এক পরিচিতের বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম আমি ও আমার স্ত্রী। আমার বাসায় তখন হামলা শুরু হয়ে গেছে। যে বাসায় গিয়ে উঠি, সেখানেও হামলা, লুটপাট শুরু হয়। একপর্যায়ে বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। হামলাবাজেরা বাথরুম সার্চ করতে চাইলে বেরিয়ে আসি। স্ত্রী’কে বলি যা হওয়ার হবে, ওদের ঠুকতে দাও। সাত-আটটা হিং¯্র ছেলে ঢ়ুকল। তখন ভাবিনি বেঁচে থাকব। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলাম।’ ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো আমাকে চিনতে পেরে ছেলেগুলো বলল, আপনার নেত্রী চলে গেছেন (হাসিনার ভারতে চলে আসা)। আপনি যাননি কেন? আমি চুপ করেছিলাম। ওদের একদল আমাকে সেনা, আর একদল জনতার হাতে তুলে দিতে চাইল। তখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। একদল আবার আমার সাথে সেলফি তুলল। কী মনে করে ওরা আমাদের রাস্তায় নিয়ে গেল। ধরে নিয়েছিলাম, জনতার হাতে তুলে দেবে। ওরা সেটা না করে আমাদের পোশাক বদল করিয়ে, মাস্ক পরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চাপিয়ে দূরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলো। রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চেক করা হচ্ছিল। গাড়ি চেক করতে আসা লোকজনকে ছেলেগুলো বলল, আমাদের চাচা-চাচিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ছেড়ে দাও। বড় রাস্তা থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী দূরে আর এক জায়গায় চলে যাই।’
তিন মাস দেশেই ছিলাম, কারণ-
‘গণঅভ্যুত্থানের পর ঝুঁকি নিয়ে তিনমাস দেশেই আত্মগোপন করে ছিলাম। দেশে থেকে যাওয়ার পেছনে আমার একটা পরিকল্পনা ছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম, শ্রমিক, কৃষক-সহ পেশাজীবী, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে যদি কিছু করা যায়। শ্রমিক-কর্মচারীদের অসন্তোষ, ক্ষোভকে সংঘঠিত করার চেষ্টায় ছিলাম।’ ‘আমি অসুস্থ। বাইপাস সার্জারি হয়েছে আগেই। অনেক ওষুধ খেতে হয়। একপর্যায়ে আমার ওষুধ খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ধরা পড়লে ওষুধ খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেত। এদিকে, মাথার উপর ১১২টা খুনের মামলা। একের পর এক নেতা ধরা পড়ছেন। তখন অনেকেই বললেন, দেশে থাকা ঠিক হবে না। একপর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হই।’
গণঅভ্যুত্থান দমনে ছাত্রলীগ, যুবলীগকে নামানোর প্রসঙ্গ
‘আমি কখনো ছাত্রলীগ, যুবলীগকে অভ্যুত্থান দমন করতে পথে নামতে বলিনি। আমার ভাষণের ভিডিওতে দেখবেন, ছাত্রলীগ কথাটাই আমি উচ্চারণ করিনি। তবে আমি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি। তারা আমাদের বি-টিভি ভবন, সেতু ভবন পুড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের অফিসে বারবার হামলা করছে। আমি কি চুপ করে থাকব? আমি কি নিজেকে, পার্টিকে, আমার নেত্রীকে বাঁচাব না? সে সময় পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে সময়ারোপিত দায়িত্ব আমি পালন করেছি। আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে তিনিও সেটা করতেন।’
গোয়েন্দা ব্যর্থতা অবশ্যই ছিল
‘আওয়ামী লীগ শেষ পর্যায়ে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা দেশ তৈরি করেছে। দল এতবড়। মানুষের ক্ষোভ দল ও প্রশাসন কেন বুঝতে পারল না? এটা একটা আকস্মিক ঘটনা। এটা শুরু হয় কোটা দিয়ে। শেষ হয় এক দফা দাবি দিয়ে। এটা একটা ষড়যন্ত্র ছিল। ইন্টেলিজেন্সের যে ব্যর্থতা ছিল সেটা তো মানতেই হবে।’
জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে অভ্যুত্থান মোকাবিলা করতে না পারার দায় নিচ্ছেন?
‘আমাকে আমার নেত্রী যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, সেভাবে কাজ করেছি। জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে আমার ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। আই অ্যাম নট ইমিউনড ফ্রম মিসটেকস। মানুষ মাত্রই ভুল করে। এমন তো নয় যে সাধারণ সম্পাদক ভুল করেন না।’
‘চাঁদাবাজি করিনি, কমিশন খাইনি, টাকা নিয়ে দলের পদ দিইনি। এই ব্যাপারে আমি নির্দোষ।’ ‘জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে নিজের কোনো ভুল নিজে চিহ্নিত করার প্রশ্নে বলতে পারি, আমি কাজ করেছি। চাঁদাবাজি করিনি। কমিশন খাইনি। পারসেন্টেজ নিইনি। আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করতে কমিশন নিইনি। কমিশনের বিনিময়ে কাউকে পদায়ন করিনি। চান্দাবাজি করিনি। সেদিক থেকে আমি নিজেরে নির্দোষ বলে দাবি করতে পারি।’ ‘আমরা ভুল করে থাকলে দেশে ফিরে ক্ষমা চাইব’ ‘শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ১৫ বছর আগের আর পরের উন্নয়নে দিন আর রাতের মতো ফারাক। আমাদের সমালোচনা তারাই করে যারা দিনের আলোয় রাতের অন্ধকার দেখে, আবার ঘোর অমাবশ্যাকে পূর্ণিমা বলে দাবি করে। সমালোচনা করার বিষয় অবশ্যই আছে। সময় হলে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সব কিছুরই মূল্যায়ন আমরা করব।’ নীরবতা কি পানিসমেন্ট? ‘গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নীরব ছিলেন। বলা হয় চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। এটা একটা পানিসমেন্ট। কিছুলোক আছে যারা এসব বলে শান্তি পায়। তাদের এক ধরনের সুখানুভূতি আছে। আমাকে তিন-তিনবার সেক্রেটারি করেছেন নেত্রী। এটা তো অনেকের পছন্দ হওয়ার কথা না। আমাদের মতো পার্টিতে প্রতিযোগিতা থাকে। আমি যখন সেক্রেটারি হয়েছিলাম তখনও ছিল। এটা অবাস্তব কিছু নয়। আমাদের মতো দেশে, আওয়ামী লীগের মতো মাল্টি ক্লাস পার্টিতে এটা স্বাভাবিক।’ নেত্রীর নির্দেশে নীরব ছিলাম,
‘আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী সবচেয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি আমাকে বলেন, তোমাকে এখন কিছু করতে হবে না। তুমি ভাল করে চিকিৎসা করাও। পারলে মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করো। কখন কী করতে হবে আমি বলে দেব। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কখনো দেখা করার চেষ্টা করিনি। কারণ, উনি যেখানে আছেন, সেটা হাইসিকিউরিটি জোন। উনি যদি প্রয়োজন মনে করেন, ঠিক আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। উনিই সম্প্রতি আমাকে সক্রিয় হতে বলেছেন। আমি ভাল করেছি কী মন্দ করেছি তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’ আওয়ামী লীগের পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে কামড়াকামড়ি ‘এই কামড়াকামড়ি অসুস্থ রাজনীতি। এখনো আমরা দেশের বাইরে। দেশ নিয়ে আমাদের আগে ভাবা দরকার। এখানে বসে পদ নিয়ে কামড়াকামড়ি করলে আমাদেরই ক্ষতি।’
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ
‘আমরা বাংলাদেশে নিজেদের জায়গা ফিরে পাব, এ নিয়ে শতভাগ আশাবাদী। জনমত সমীক্ষার রিপোর্ট দেখুন, বেশিরভাগ মানুষ বলছেন, শেখ হাসিনাই ভালো ছিলেন। আগে ভালো ছিলাম।’ আওয়ামী লীগ একঘরে? আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা নিয়ে ভারত সরকার ছাড়া আর কোনো দেশ প্রতিক্রিয়া দেয়নি। আওয়ামী লীগ কি একঘরে? মোটেই না। আমরা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে কোনো দেশ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে চাই না।
দুঃখ প্রকাশ, ক্ষমা প্রার্থনা
ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে সেটা দেশে ফিরে বলব। ভারতে বসে বলব কেন? আমার, আমাদের ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে সেটা বলার জন্য আমাদের নেত্রী আছেন। তিনিই দেশে ফিরে দেশবাসীকে বলবেন। এখান থেকে বলা কি ঠিক?

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button