জাতীয় সংবাদ

পদোন্নতি ও পুরস্কারের লোভে গুম-খুন-নির্যাতনে যুক্ত হতেন অনেকে: প্রেস সচিব

প্রবাহ রিপোর্ট : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, গুম কমিশনের প্রতিবেদনে টর্চার কীভাবে হয় এবং কারা কারা অপরাধী ছিল তা উঠে এসেছে। এককভাবে র‌্যাবের গোয়েন্দা ইউনিট সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যক্তিকে গুমের সঙ্গে জড়িত ছিল। কমিশনের প্রতিবেদনে ভিকটিমদের কীভাবে তাদের গুম করা হতো এবং কীভাবে মারা হতো সেই চিত্র ফুটে উঠেছে। যারা এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তারা কী কারণে যুক্ত হয়েছেন সেটিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। দেখা গেছে যে পুলিশের মধ্যে অনেকে ভালো পোস্টিং (ঢাকায়), ভালো পজিশন ও বার্ষিক পুরস্কার (পিপিএম বিপিএম) বাগিয়ে নিতে এসব অপরাধে যুক্ত হন। বিষয়টা এমন ছিল যত অপরাধ করবেন তত সুনাম বাড়বে। তবে পুলিশের মধ্যে অনেকে এগুলো করতে চাননি এমন আবেদনপত্র ও গণভবন থেকে উদ্ধার হয়েছে। অপরাধের মাত্রা এমন বিস্তৃতি ছিল যা কল্পনাতীত। অপরাধের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিকটিমদের কাউকে নৌকায় নিয়ে যাওয়া হতো, তাকে হত্যা করে পেট কেটে সিমেন্ট করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো, কাউকে গুলি করে, ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করা হতো। কাউকে আবার হত্যা করে ট্রেনে বস্তাবন্দি করে ট্রেন লাইনের পাশে ফেলে রাখা হতো, ট্রেনের নিচে পিষ্ট হয়ে লাশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত, কখনো চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হতো। গতকাল বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে এসব তথ্য জানান তিনি। শফিকুল আলম জানান, গুম সংক্রান্ত কমিশন তাদের দ্বিতীয় মধ্যবর্তীকালের (ইন্টেরিম) প্রতিবেদন গতকাল বুধবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছেন। গুম কমিশনের চারজন সদস্য এসময় উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- বিচারপতি মইনুল ইসলাম, নুর খান লিটন, সাজ্জাদ হোসেন এবং নাবিলা ইদ্রিস। ভিকটিম ও অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের জবানবন্দি থেকে গুমসংক্রান্ত কমিশন এ তথ্য জানতে পেরেছে। প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা শুনে বলেছেন, এটি একটি ভয়াবহ বিষয়। এ বিষয়ে একটি হরর মিউজিয়াম হওয়া উচিত। শফিকুল আলম জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মরণে গণভবনে একটি জাদুঘর করা হচ্ছে, সেখানে একটি অংশে হরর মিউজিয়ামও রাখা হবে। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা গুম সংক্রান্ত কমিশনের সদস্যদের একটি ওয়েবসাইট খোলা ও সেখানে প্রতিটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরামর্শ দেন। শফিকুল আলম আরও জানান, যারা এই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা আমাদের আশপাশেরই লোক। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূস এ সত্যিগুলো বাংলাদেশের সবাইকে জানার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, গুমের ভয়াবহতার এই ঘটনাগুলো এখন শুধু বাংলাদেশের বিষয় নয় এটি বৈশ্বিক (গ্লোবাল) বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বহু দেশের মানুষ ও অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন শেখ হাসিনার আমলে ভয়াবহ এইসব ঘটনা সম্পর্কে জানতে চায়। প্রেস সচিব আরও বলেন, সর্বোচ্চ সংখ্যক ব্যক্তিকে গুম, খুন ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিল এলিট ফোর্স খ্যাত র‌্যাব। তারা ভিকটিম ভেদে গুম করে নৌকায় করে নিয়ে হত্যা করে পেট কেটে নদীতে ফেলে দিতেন। কাউকে গুলি কিংবা ইনজেকশন দিয়ে হত্যা করতেন। কাউকে আবার হত্যা করে ট্রেনে বস্তাবন্দি লাশটি ট্রেন লাইনের পাশে ফেলে রাখতেন। ট্রেনের নিচে পিষ্ট হয়ে লাশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেওয়ারিশ হয়ে যেত। আবার কাউকে চলন্ত গাড়ির সামনে ফেলে দেওয়া হতো। তিনি বলেন, র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার ভিকটিমদের কল্পনাতীত ভয়াবহ ঘটনা বাংলাদেশ তথা ও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে রাজধানীর গণভবনের নির্মিতব্য জাদুঘরের একটি অংশে ‘হরর মিউজিয়াম’ স্থাপিত হবে। কমিশন তাদের প্রতিবেদনের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। প্রতিবেদনের বিস্তারিত শোনার পর প্রধান উপদেষ্টা গুম সংক্রান্ত বিষয়ে আশুকরণীয় কী কী তা জানতে চান এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গুম কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন যেন দ্রুত দেওয়ার জন্য তাগিদ দেন। তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আইন ও বিচার এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান। শফিকুল আলম জানান, গুম কমিশনের পূর্ববর্তী প্রতিবেদনে এক হাজার ৭৭০ জন ব্যক্তির গুমের অভিযোগ ছিল। দ্বিতীয় দফার প্রতিবেদনে এ সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৮৫০ জন বলে জানানো হয়। গত মঙ্গলবার পর্যন্তও নতুনভাবে গুমের শিকার ভিকটিমের স্বজনদের অভিযোগ পাওয়া অব্যাহত রয়েছে বলে জানান। তিনি জানান, মোট প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে এক হাজার ৩৫০টি গুমের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনরা কমিশনের কাছে সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত ঘটনা তুলে ধরেছেন। কারও কারও ক্ষেত্রে দুই-তিন ঘণ্টা আবার কেউবা একাধিক দিন সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। গুম কমিশনের সদস্যরা কখনো কখনো গোটা সপ্তাহ ধরেই এ নিয়ে কাজ করছেন। কমিশনের সদস্যরা প্রয়োজনে ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। শফিকুল আলম জানান, আইনগত কারণে গুম কমিশনের প্রতিবেদনের সবগুলো অধ্যায় প্রকাশ না করলেও তারা সাতটি অধ্যায় প্রেস উইংয়ের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যমে প্রকাশ করবেন। প্রতিদিন দুটি করে অধ্যায় প্রকাশ করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button