সুন্দরবনে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা : টিকে থাকার লড়াইয়ে বননির্ভর জনগোষ্ঠী

শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি ঃ
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত সুন্দরবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমে তিন মাসের জন্য সব নদ-নদী ও খালে মাছ ও মধু আহরণ বন্ধ এবং দেশী-বিদেশী পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে সুন্দরবন বিভাগ। বন বিভাগের এই সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে, বনজীবী ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা সুন্দরবনের বাংলাদেশের অংশে বহাল থাকবে। গোটা সুন্দরবনে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে গত ২৪ মে থেকে জেলে, মৌয়ালী ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা এ জেড এম হাসানুর রহমান বলেন, এই তিন মাস সুন্দরবনে মাছ কাঁকড়া ও বনপ্রাণীর প্রজনন মৌসুম হিসেবে সরকার চিহ্নিত করেছে সে কারণে এই তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষিদ্ধ সময় আইন অমান্য করে যারা সুন্দরবনের প্রবেশ করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বন বিভাগের এই সিদ্ধান্তে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল জেলে, বনজীবী ও পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনে মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ২০১৯ সাল থেকে বন বিভাগ প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখে। ২০২১ সালে দুই মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও ২০২২ থেকে তা আরো এক মাস বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ে সুন্দরবনে সব ধরনের পর্যটকের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়।
সুন্দরবনের ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশের অংশে জলভাগের পরিমাণ ১,৮৭৪.১ বর্গকিলোমিটার, যা সমগ্র সুন্দরবনের আয়তনের ৩১.১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগকে বলা হয় মৎস্য সম্পদের ভান্ডার। এই জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদামাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও ১ প্রজাতির লবস্টার রয়েছে। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস মাছের প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশিরভাগ মাছের ডিম থেকে নতুন মাছ জন্ম নেয়। তাই এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ সব জীবের জন্য ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগ।
সুন্দরবন বিভাগ জানায়, মৎস্য সম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট প্লান (আইআরএমপি) এর সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে বন বিভাগ প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধ রাখে। গত ২০২২ সাল থেকে এই সময় আরও এক মাস বাড়িয়ে (১ জুন) থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করেছে মন্ত্রণালয়। এই তিন মাসে সমগ্র সুন্দরবনের সব নদী ও খালে মাছ আহরণ বন্ধের পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। সুন্দরবনে প্রবেশের সব ধরণের পারমিট বন্ধ রাখা হয়েছে। এই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ থাকায় নদী-খালে মাছ বৃদ্ধি পাবে।
সুন্দরবনে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞায় হতাশা প্রকাশ করে বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার জেলে ইব্রাহীম শিকদার, রুস্তম আলী বয়াতী, আলী আকবরসহ অনেকে জানান, এই নিষেধাজ্ঞার সময় আমরা পরিবার নিয়ে কী খেয়ে বাঁচবো? মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে সারা বছর সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। এখন বন বিভাগ মাছ ধরা বন্ধ করায় আমাদের তিন মাস বেকার থাকতে হবে। সমুদ্রের মৎস্য আহরণ বন্ধের সময় মৎস্য বিভাগ যেভাবে জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেয়, সেভাবে আমাদেরও প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। তা না হলে পেটের দায়ে অনেকে এই সময়ে অবৈধভাবে সুন্দরবনে ঢুকে মাছ আহরণ করতে বাধ্য হবে। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এই ম্যানগ্রোভবনে বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন নির্বিঘœ করতে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের নদ-নদী ও খালে মাছ ও মধু আহরণ বন্ধসহ দেশী-বিদেশী সব পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এজন্য গত ২৪ মে থেকে জেলে, মৌয়ালী ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশের পারমিট দেয়া বন্ধ করেছে।
এই তিন মাস সুন্দরবনে মাছ ও মধু আহরণসহ সব ধরনের পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে সুন্দরবনে কেউ যেতে পারবেন না। এই নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগেই জেলে, মৌয়ালী ও সব পর্যটকদের সুন্দরবন থেকে বের করে আনা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সুন্দরবন সন্নিহিত লোকালয়ে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এবার সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল দরিদ্র বনজীবীদের তালিকা করে তাদের খাদ্য সহায়তা ও প্রণোদনা দেয়ার জন্য বন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
মোংলা উপজেলা জেলে সমিতির সভাপতি বিদ্যুৎ মন্ডল বলেন, এই তিন মাস জেলে পরিবারদের চাহিদা মিটিয়ে সরকার সহায়তা না করতে পারলে বনজীবীরা চুরি করে সুন্দরবনে যেতে বাধ্য হবে। কারণ সংসারে যখন বাচ্চারা কান্না কাটা করবে তখন ওই পরিবার প্রধানের আর অপরাধের কথা মনে রাখতে পারে না। তাই এটাকে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে প্রকৃত জেলে পরিবারদেরকে আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে অন্যথায় বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
সুন্দরবন ট্যুর অপারেটর এমাদুল জানান, তিন মাস সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশ নিষেধাজ্ঞায় পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত দুই হাজারের অধিক পরিবার দারুণ অর্থ সংকটে পড়েছে ও মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি সুন্দরবনের এই নিষেধাজ্ঞার সময় এক মাসে নামিয়ে আনার দাবি জানান।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনগামী জেলেদের বিষয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ চলছে এবং এ নিয়ে শিগগিরই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।
উপজেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনগামী নিবন্ধিত জেলেদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। তবে অনিবন্ধিত জেলেসহ এই সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেরা।