স্থানীয় সংবাদ

খুলনা বিভাগে শীর্ষ মাদক চোরাকারবারি পুরুষ-মহিলাসহ ১৩৭ জন

# মাদক ব্যবসায়ী রাসেলের বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা, অভিযানের সময় পালিয়ে যায়
# চুনোপুটি ছাড়া গ্রেফতার হয়না কোন গডফাদার #

কামরুল হোসেন মনি :
খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় শীর্ষ মাদক চোরকারবারির পুরুষ ও মহিলা মিলে রয়েছে ১৩৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ১২৪ জন। এ সব শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা নিজেদের বাহিনীদের দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিশ, র‌্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুলনার বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্যের বড় বড় চালান ধরে। মাদকদ্রব্য বহনের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করা হয়। মাদকবহণকারীরা গ্রেফতার হলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় গডফাদাররা। পণ্যবাহী গাড়ি, পিকআপ, ট্রাক, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে নানাভাবে খুলনায় আসছে মাদকের চালান।
সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন সময় মাদকের চালান আটক করা হয়েছে। কিন্তু সব চালানের তথ্য জানা যায় না।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ মাদক কারবারীর তালিকায় দেখা গেছে, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় শীর্ষ মাদক চোরাকারবারী রয়েছে ১৩৭ জন। এর মধ্যে খুলনায় ৯ জন, যশোরে ২০ জন, সাতক্ষীরায় ৪ জন, বাগেরহাটে ২৬ জন, ঝিনাইদহে ৭ জন, নড়াইলে ২১ জন, মেহেরপুরে ১১ জন, চুয়াডাঙ্গায় ১০ জন, কুষ্টিয়ায় ৮ জন এবং মাগুরায় ২১ জন। এসব শীর্ষ মাদক চোরাকারবারীদের মধ্যে মহিলারা রয়েছে ১৩ জন।
গত ১ জুলাই কেএমপির হরিনটানা থানাধীন জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে ১৯ হাজার পিস ইয়াবাসহ ওমর ফারুক নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। সে সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা এলাকার বাসিন্দা মশিয়ারের ছেলে। হরিণটানা থানার ওসি খায়রুল বাশার বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়। কিন্তু মূল মাদকের গডফাদারের নাম জানা যায়নি। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসায়ী বর্তমানে মোবাইল নম্বরকে কোড হিসেবে ব্যবহার করছে। যার মাধ্যমে ইয়াবা পৌছায় দেবে তার শুধু মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে কন্ট্রাক হয়।
এর আগে গত ৪ জুন খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভাগীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নড়াইল জেলার নড়াগাতি থানাধীন বড় দিয়া বাজারস্থ অভিযান চালিয়ে ৪ হাজার ৫ পিস ইয়াবা, গাজা ২০০ গ্রাম, মাদক বিক্রির নগদ ১ লাখ ৮ হাজার ১০০ টাকাসহ মো: মিরাজুল ইসলাম ওরফে সিরাজ (৪৮) কে আটক করে। সে ওই এলাকার বাসিন্দা মৃত আবু বক্কর মোল্লার পুত্র। এ সময় আরো দুইজন আসামি মো: সোহেল শেখ ও মো: মোস্তফা মোল্ল্যা অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে যায়। এই মামলায় তাদেরকে আসামি করা হয়। খুলনা মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক এস কে ইফতেখার মোহাম্মদ উমায়ের বলেন, জুন মাসে নড়্ইাল জেলায় সর্বোচ্চ ইয়াবার চালানটি আটক করা হয়। এ সময় মাদক বিক্রয়ের নগদ টাকাও জব্দ করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এর আগে গত ২১ মে রাতে লবনচরা থানা পুলিশ বিশ^ রোড সাচিবুনিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০ কেজি গাজাসহ মাদক ব্যবসায়ী মহিলাসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করে। এরা হচ্ছে আলেয়া(৬০), রুহুল আমিন (৩০) এবং আনোয়ার হোসেন সোহাগ (৩৫)। সোহাগ নগরীর দোলখোলা এলাকার বাসিন্দা মৃত আমজাদ হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় লবনচরা থানায় ৪ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয় যার নং-২৩, তারিখ ২২/০৫/২৫। এর গাজার চালানের মূল মালিক ছিলো রাসেল (৪২)। সে নগরীর সোনাডাঙ্গা থানাধীন ময়লাপোতার ( সন্ধ্যা বিপরীত পাশে) বাসিন্দা মৃত নাসিম উদ্দিনের ছেলে। তার বাবা একজন চিকিৎসক ছিলেন বলে পুুলিশ সূত্রে জানা যায়। মামলার এজাহারের উল্লেখ করা হয়, ৩নং আসামি মো: আনোয়ার হোসেন সোহাগ জানায়, তার হেফাজত হতে জব্দকৃত ২ কেজি গাজার মালিক, অর্থযোগানদাতা এবং মাদকদ্রব্য গাজা ক্রয়-বিক্রয় ৪নং পলাতক আসামি রাসেল (৪২)। ধৃত আসামি এবং পলাতক আসামি অবৈধ মাদক বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে নিজ হেফাজতে রেখে এবং মাদকদ্রব্য ক্রয়/বিক্রয় এবং মাদকদ্রব্য ক্রয় বিক্রয় পৃষ্টপোষকতা এবং অর্থযোগান দিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে অপরাধ করেছে। মামলার বাদী মো: শরিফুল ইসলাম বলেন, পিসির্আ সার্চ করে দেখা যায় সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় রাসেলের নামে আরও একটি মাদকের মামলা রয়েছে। লবনচরা থানার ওসি মো: তৌহিদুজ্জামান বলেন, ওই দিন রাতে মাদক ব্যবসায়ী রাসেলকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হয়েছিলো কিন্তু তার আগেই সে পালিয়ে যায়।
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার সূত্রে জানা যায়, পলাতক মাদক ব্যবসাীয় রাসেলের বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। এছাড়া তার একটা কুকুর রয়েছে। কেউ তার বাসায় ঢুকতে গেলে কুকুর চিৎকার চেঁচামেচি করে। তখন সে সিসি ক্যামেরা দেখে সনাক্ত করে কে তার কাছে আসছে। সিসি ক্যামারায় পুলিশ দেখে সে ওই মুহুর্তে পালিয়ে যায়। রাসেলের বাড়িতে একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। মাদক ব্যবসায়ী রাসেল দীর্ঘ ১৫-২০ বছর ধরে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে বলে ওই সূত্রটি জানায়। ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাজা ব্যবসার সাথে জড়িত।
পুলিশের সূত্রে জানা যায়, রূপসা সেতু এলাকা মাদকদ্রব্যের হাতবদলের একটি অন্যতম এলাকা। সেখান থেকেই বড় চালানগুলো ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন স্থানে। যেগুলো সড়কপথে আসে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে। যা পরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে খুচরা বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লবণচরা, বুড়ো মৌলভীর দরগা এলাকা, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের ডিআইজির মাঠ, বাগমারা ব্রিজ, সোনাডাঙ্গা আল ফারুক মোড়, ময়লাপোতা, আলী ক্লাব, গল্লামারী, বয়রা কলাবাগান, দৌলতপুরসহ বিভিন্ন এলাকা।
মাদকদ্রব্য বহনের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করা হয়। কখনো বহনকারীদের দৈনিক ৫০০ বা এক হাজার টাকা দেওয়া হয়। কখনো কখনো দু-এক পিস ইয়াবা দিয়েও বহন করানো হয়। পরে ওই ইয়াবা তারা আবারও বিক্রি করে দেয়। অনেক সময় তারা সেগুলো সেবনও করে। মাদকদ্রব্য বহনের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয় পৃথক মোবাইল নম্বর। যে কারণে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ট্র্যাকিং করেও মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে পারছে না। মাদকদ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে ইয়াবা ও গাঁজার প্রচলন বেশি। যেগুলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আসছে ভারত-মায়ানমার থেকে। মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ফলে খুলনা-ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটকে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসায়ীরা। এ ব্যবসার সঙ্গে সংশি¬ষ্ট এলাকার চিহ্নিত ও দাগি মাদক ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক নতুন মুখও জড়িয়ে পড়ছে।
খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: মিজানুর রহমান বলেন, চলতি বছরের খুলনা মহানগরী চানমারী বাজার এলাকায় আশিক বাহিনীর গ্রুপের প্রধান আশিকের বাড়িতে যৌথবাহিনীসহ আমরা একযোগে অভিযান পরিচালনা করেছিলাম। অভিযানে দেখি আশিকের পুরো বাড়িটি সিসি ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রণে ছিলো। অভিযানের আগে আশিক পালিয়ে যায়। পরে তার বাড়িতে লাগানো সব সিসি ক্যামারা জব্দ করে আদালতে প্রেরণ করি। তিনি আরও বলেন, যদি কোন মাদক ব্যবসায়ীর বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকে তাহলে আমরা জব্দ করবো।
কেএমপির সহকারি পুলিশ কমিশনার খোন্দকার হোসেন আহমদ (মিডিয়া এ- পিসি) বলেন, মাদক ব্যবসায়ীর কোন বাড়িতে সিসি ক্যামেরা আছে কি না বিষয়টি আমার নলেজে নেই। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button