টিকিট নয়, এখন আতঙ্কের নাম ‘ইঞ্জিন বিকল’

ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলরুটটি চালুর পর পর্যটকদের স্বপ্নপূরণের এক অনন্য মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। সমুদ্রপ্রেমী যাত্রীদের কাছে ট্রেনের টিকিট ছিল যেন সোনার হরিণ। কিন্তু জনপ্রিয় এই রুটেই এখন বারবার ইঞ্জিন বিকলের ঘটনা যাত্রীদের মাঝে উদ্বেগ-ভোগান্তির নামান্তর হয়ে উঠেছে। ফলে স্বস্তির যাত্রা এখন রূপ নিয়েছে অনিশ্চয়তার যাত্রায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনা বারবার ঘটছে এবং প্রতিবারই যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কখনো যাত্রার শুরুতেই, কখনো বা মাঝপথে ট্রেন থেমে যাচ্ছে। যাত্রীদের দীর্ঘ সময় আটকে থাকা, যাত্রা বাতিল, পুনরায় যন্ত্রাংশ পাঠানো-সব মিলে রেলভ্রমণের সেই নির্ভরতা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে ব্যবহৃত ১৪০টি ইঞ্জিনের মধ্যে প্রায় ৮২টি দুই দশক পুরোনো। অথচ রেলইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল সাধারণত ২০ বছর। মানসম্পন্ন নতুন ইঞ্জিন সরবরাহ না হওয়া এবং পর্যাপ্তসংখ্যক সচল ইঞ্জিন না থাকায় চাহিদা পূরণে বারবার হোঁচট খাচ্ছে রেলওয়ে। দৈনিক গড়ে যেখানে ১১৩-১১৬টি ইঞ্জিন দরকার, সেখানে কার্যত মেলে ৮০-৮২টি। ফলে, একটি ইঞ্জিনকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা রক্ষণাবেক্ষণ না দিয়েই পুনঃব্যবহার করতে হচ্ছে, যা মাঝপথে বিকলের অন্যতম কারণ। এই সংকট কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতাও। ২০২১ সালে নতুন ২৯টি ইঞ্জিন কেনা হলেও সেগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি ও রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার চিত্রই বারবার ভেসে উঠছে এসব ঘটনায়। যাত্রীদের ওপর এর প্রভাব সুস্পষ্ট। যারা দিনপূর্বে টিকিট কেটে পরিবারসহ ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, তারা হঠাৎ যাত্রা বাতিলের খবর পেয়ে চরম হতাশায় পড়ছেন। সময়, অর্থ ও মানসিক চাপ-সবকিছু মিলে এটি এখন আর যাত্রা নয়, যেন প্রতীক্ষার নামান্তর। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। তবে প্রশ্ন হলো-এই “চেষ্টা”আর কতদিন চলবে? জনআস্থা অর্জন করতে হলে চেষ্টা নয়, দরকার বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা, গুণগতমানসম্পন্ন ইঞ্জিন সরবরাহ, রক্ষণাবেক্ষণে শৃঙ্খলা এবং যান্ত্রিক বিভাগের দক্ষতা বাড়ানো। কক্সবাজার রেলরুট শুধু একটি যোগাযোগ মাধ্যম নয়, এটি দেশের পর্যটন অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় রূপও। এই সম্ভাবনাকে যদি অব্যবস্থাপনা ও বারবার যান্ত্রিক বিপর্যয় ধ্বংস করে দেয়, তবে সেটি হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়ের একটি বড় উদাহরণ। রেলওয়ের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে-ইঞ্জিন সংকট দ্রুত সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। প্রয়োজনে বিদেশি কারিগরি সহায়তা, রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নতুন প্রকল্পে মাননিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। ট্রেন যাত্রীদের কাছে ‘ভ্রমণ’ যেন আবারও ‘ভরসার’ সমার্থক হয়ে ওঠে-এটাই প্রত্যাশা।