সম্পাদকীয়

মামলাজট: বিচারপ্রাপ্তির আশায় অপেক্ষার দীর্ঘ সারি

দেশে বিচারপ্রক্রিয়ার অন্যতম বড় সংকট হয়ে উঠেছে মামলাজট। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই নতুন করে ৫৪ হাজার মামলা বিচারাধীন তালিকায় যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ১৬৮টি। এ সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি প্রতিফলন-একটি ভারসাম্যহীন ও চাপগ্রস্ত বিচার ব্যবস্থা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে নতুন মামলা দায়ের হয়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৮৬০টি। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৮টি। অর্থাৎ নতুন মামলার তুলনায় নিষ্পত্তির হার এখনও অনেক পিছিয়ে। এরই মধ্যে চলতি সময়ে বদলি করা হয়েছে আরও ২ লাখ ১৫ হাজার ৯৮১টি মামলা। সব মিলিয়ে বিচার ব্যবস্থায় চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে বেশি মামলাজট রয়েছে অধস্তন আদালতগুলোতে। বর্তমানে এসব আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৯ লাখ। হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন প্রায় ৬ লাখ এবং আপিল বিভাগে ৩৫ হাজারের কাছাকাছি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারকসংখ্যার ঘাটতি, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং মামলার বাড়তি প্রবাহ-সব মিলিয়ে এটি একটি কাঠামোগত সংকটে পরিণত হয়েছে। বিচার বিভাগের সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদনে মামলাজট কমাতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, বিচারকসংখ্যা বৃদ্ধি করে অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করা, সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দমন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত করে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া বিচারিক প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির (অউজ) ব্যবহার বাড়ানো এবং দ্রুত মামলার নিষ্পত্তিতে পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন-এসবও সুপারিশে উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব সুপারিশ পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়ন করা গেলে মামলাজট অনেকটাই কমে আসবে। প্রধান বিচারপতির ঘোষিত রোডম্যাপ মামলাজট নিরসনে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে রোডম্যাপ কেবল ঘোষণাতেই সীমিত থাকলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের গতি না বাড়ালে সমস্যা আরও প্রকট হবে। মামলাজট শুধু আইনি সমস্যা নয়, এটি জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারেও হস্তক্ষেপ করে। বছরের পর বছর একটি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া, সাক্ষী না আসা, আদালতের তারিখ পেছানো-এসব চিত্র একদিকে জনগণের ভোগান্তি বাড়ায়, অন্যদিকে বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থাহানি সৃষ্টি করে। ন্যায়বিচার পেতে জনগণ যখন আদালতের দ্বারস্থ হয়, তখন তাদের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা নয়, বরং সময়মতো বিচারই হওয়া উচিত। মামলা দায়ের ও নিষ্পত্তির মধ্যকার ব্যবধান যতদিন থাকবে, ততদিন বিচারপ্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই থেকে যাবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button