সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ আরও একজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ৫

পুলিশের গাড়ি পোড়ানোয় ৫শ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা
যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৪৫
হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ ৪৭ বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকের
প্রবাহ রিপোর্ট : গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চৌরঙ্গী লঞ্চ ঘাট এলাকায় (কোর্টের সামনে) গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (২৮) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে তিনি মারা যান। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৫ জনে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান, মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে রাখা আছে। রমজান মুন্সী গত ১৬ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০১ নাম্বার ওয়ার্ডে ভর্তি হন। নিহত রমজান মুন্সির ভাই হিরা মুন্সি জানান, তার ভাই রিকশা চালাতেন। বুধবারের সংঘর্ষের সময় তিনি এক যাত্রীকে পৌঁছে দিতে রিকশা নিয়ে লঞ্চ ঘাট এলাকায় যান। তখন সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। রমজান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে দাবি করেন হিরা মুন্সি। তিনি ভাইয়ের হত্যার বিচার দাবি করেন। গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় এ নিয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হলো। এর আগে গত বুধবার ঘটনার দিনই চারজন নিহত হন। তারা হলেন- মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের দোকানি সোহেল মোল্লা (৩৫), পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহা (২৫), সিরামিক পণ্যের দোকান কর্মচারী ইমন তালুকদার (১৭) ও রাজমিস্ত্রির সহযোগী রমজান কাজী (১৮)।
পুলিশের গাড়ি পোড়ানোয় ৫শ’ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, মারপিট ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪৫০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার গোপিনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন বলে গতকাল শুক্রবার বিকাল সোয়া ৩টার দিকে জানিয়েছেন গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান। ওসি সাজেদুর বলেন, বুধবার সকালে এনসিপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট আঞ্চলিক সড়কের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল পুলিশ। এ সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বে একদল লোক অতর্কিতে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে। তারা পুলিশ সদস্যদের মারপিট ও গাড়ি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় পরিদর্শক আহম্মেদ আলীসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় মামলায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা-সাধারণ সম্পাদক আতাউর পিয়ালসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ ৪৫০-৫০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলে জানান ওসি।
যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৪৫ : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় গোপালগঞ্জে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গতকাল শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মোট ৪৫ জনকে আটক করা হয়। গোপালগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মো. সাজেদুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মির মো. সাজেদুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় সদর থানায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জন আটক আছেন। তাদের থানায় রাখা হয়েছে। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযানে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছিল। অন্য ২০ জনকে গতকাল রাতে যৌথ বাহিনী গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে থানায় হস্তান্তর করেছে। ওসি আরও বলেন, গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর ইউনিয়নের খাটিয়াগড় চরপাড়া এলাকায় পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমদ বিশ^াস বাদী হয়ে একটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই মামলায় নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হবে। আটকের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও আদালতে কেন তোলা হয়নি- এ প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, এ বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে তোলা হবে। এদিকে পাঁচজন নিহত ও সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও মামলা না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, বুধবার এনসিপির পদযাত্রা ঘিরে দিনভর গোপালগঞ্জে দফায় দফায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ হামলায় অংশ নেন। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। অন্তত আটজন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই রাতেই গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করে প্রশাসন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার সরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী গোপালগঞ্জের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে এক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, কারফিউয়ের সময় দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে আজ (শুক্রবার) বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং আংশিক শিথিল করে বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়।
হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ ৪৭ বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকের : জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি সময় গোপালগঞ্জে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ৪৭ জন শিক্ষক। শিক্ষকরা যৌথ বিবৃতিতে জানান, এই বর্বরতা শুধু রাজনৈতিক সমাবেশে হামলা নয়; বরং জুলাই বিপ্লবের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটানো হয়। গোপালগঞ্জে এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচির ওপর বর্বরোচিত হামলা, ককটেল বিস্ফোরণ, ইউএনওসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশ সদস্যদের আহত করা অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত। তারা মনে করেন, এই হামলা শুধু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়; বরং দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাকস্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। শিক্ষকরা দোষীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার কার্যক্রম শুরুরও দাবি জানান। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এনসিপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে সারা দেশ থেকে সন্ত্রাসীদের গোপালগঞ্জে জড়ো করেছে। শিক্ষকরা বলেন, অবিলম্বে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও পেশাদার সদস্যদের সমন্বয়ে ঢেলে সাজানোর দাবি জানান। বিবৃতি দেয়া শিক্ষকরা হলেন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো: সিরাজুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহিব্বুল্লাহ ও অধ্যাপক ড. কাজী মো: বরকত আলী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. খোন্দকার লুৎফুল এলাহী ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো: শামসুজোহা, অধ্যাপক ড. মো: সোহাইবুর রহমান ও অধ্যাপক ড. আবু খায়ের মোকতাদিউল বারী চৌধুরী, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের মো: কবীর উদ্দিন, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের ড. এএফজি মাসুদ রেজা, ডুয়েট-এর শেখ মো: রোকনুল ইসলাম, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো: সুজাহাঙ্গীর কবির সরকারসহ মোট ৪৭ জন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক।