অর্থনীতির গতি ফেরাতে প্রয়োজন বাস্তবমুখী উদ্যোগ

বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচকে ধীরগতির ইঙ্গিত স্পষ্ট। শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা, বিনিয়োগে আস্থাহীনতা এবং ব্যাংক খাতে অনিয়ম-এই সমন্বিত চিত্র অর্থনীতিকে দিনদিন আরো দুর্বল করে তুলছে। বিশেষত উদ্যোক্তাদের মনে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ডলার সংকট, জ্বালানির ঘাটতি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা একসঙ্গে কাজ করছে নিরুৎসাহের অনুঘটক হিসেবে। ফলে নতুন বিনিয়োগ আসছে না, পুরোনো অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে না পেরে কার্যক্রম বন্ধ করছে। কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়ার ফলে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা এবং ব্যক্তি পর্যায়ে আর্থিক দুরবস্থা। এই প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও নীতিনির্ধারণে দুর্বলতা, বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং কার্যকর সমন্বয়ের অভাব এ সংকট নিরসনে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রমে আস্থা সঞ্চারের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর উদ্যোগ হিসেবে কিছু ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন, কিংবা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হলেও তা সমস্যার গোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, খেলাপি ঋণের সমস্যার সমাধানকল্পে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও বাস্তবতা বিবেচনায় তা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে। মহামারি-পরবর্তী সময়ে বহু ব্যবসায়ী অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন। বর্তমানে তাঁদের আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা পুনরুদ্ধার ও ঘুরে দাঁড়ানোর পথকে আরো কঠিন করে তুলছে। বড় ঋণ সহায়তা কমিটির কার্যক্রমেও কার্যকর অগ্রগতি অনুপস্থিত, যা বড় শিল্প গ্রুপগুলোর অবস্থাকে আরো দুর্বল করে তুলছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতার এ চিত্র আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। বিশ^ব্যাংক সম্প্রতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৪.১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩.৩ শতাংশে নামিয়েছে, যা ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। এই পরিস্থিতিতে কৌশলগত ভুল শোধরানো, দুর্বল নীতির সংস্কার এবং বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য। শুধু নীতিমালার কাগুজে ঘষামাজায় ফল আসবে না; দ্রুত ও দক্ষ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব হবে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত না হলে কর্মসংস্থান বাড়বে না, আয় বাড়বে না, এবং সমাজে স্থিতিশীলতা ফিরবে না। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ প্রশাসনিক নেতৃত্ব এবং আর্থিক খাতের প্রতি কঠোর নজরদারি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি, ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা এবং জনগণের বাস্তবতা-এই তিনটি স্তরের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করেই কেবল সম্ভব হবে অর্থনীতিকে আবার গতিশীল পথে ফিরিয়ে আনা।