জাতীয় সংবাদ

গোপালগঞ্জকা-ে ৪ হত্যা মামলা, আসামি ৬ হাজার

কারফিউয়ের পর ফের ১৪৪ ধারা

প্রবাহ রিপোর্ট : গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশ ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চার জন নিহতের ঘটনায় চারটি পৃথক মামলা করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে গোপালগঞ্জ সদর থানায় এসব মামলা করা হয়। গোপালগঞ্জে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- গোপালগঞ্জ পৌরসভার উদয়ন রোডের বাসিন্দা দীপ্ত সাহা (২৫), জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার সোহেল রানা মোল্লা (৩৫), কোটালীপাড়া উপজেলার বান্ধাবাড়ি ইউনিয়নের হরিণাহাটি গ্রামের রমজান কাজী (১৮), ভেড়ার বাজার ব্যাপারীপাড়া এলাকার ইমন তালুকদার (১৮) ও থানাপাড়া এলাকার রমজান মুন্সী (৩৫)। এর মধ্যে চার জনের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। সোহেল হত্যা হামলার বাদী এসআই আবুল কালাম আজাদ, দীপ্ত সাহা হত্যা মামলার বাদী এসআই শামীম হোসেন, ইমন হত্যা মামলার বাদী এসআই শেখ মিজানুর রহমান ও রমজান কাজী হত্যা মামলা করেন এসআই আইয়ুব আলী। হত্যা মামলার প্রতিটিতে অজ্ঞাত দেড় হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে রমজান মুন্সীর মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। প্রধানত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের অজ্ঞাতপরিচয়ের নেতাকর্মী ও দুষ্কৃতিকারীকে আসামি করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গত শনিবার রাতে এসব মামলা করা হয়েছে। বাকি একজনের হত্যা মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে মামলার কপি চাওয়া হলে এখনই দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান তিনি। গোপালগঞ্জ সদর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ সদর থানার এসআই আইয়ুব হোসেন বাদী হয়ে কিশোর রমজান কাজী হত্যার ঘটনায় মামলা করেছেন। এ মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত বুধবার দুপুরে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শেষ করে গোপালগঞ্জ থেকে মাদারীপুরে যাওয়ার পথে গোপালগঞ্জ শহরের এসকে সালেহিয়া মাদ্রাসার কাছে পৌঁছালে এক হাজার ৫০০ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাসহ দুষ্কৃতিকারীরা গাড়িবহরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় দুর্বৃত্তদের হটাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বাধা দেয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি চালায়। এ সময় রমজান কাজী (১৭) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়াও বাকি তিনটি মামলার বর্ণনা ও আসামির সংখ্যা একইরকম। দীপ্ত সাহার (২৭) মৃত্যুর ঘটনায় সদর থানার এসআই শামীম হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত এক হাজার ৫০০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। এজাহারে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ দুষ্কৃতিকারীরা দুপুর আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এ সময় গোপালগঞ্জ শহরের কলেজ মসজিদের পাশে মিলন ফার্মেসির সামনের দীপ্ত সাহা গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে গোপালগঞ্জ ২৫০ টা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সদর থানার এসআই আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে সোহেল রানা মোল্লা (৩০) হত্যার ঘটনায় মামলা করেন। এই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গোপালগঞ্জ শহরের লঞ্চঘাট নামক এলাকায় আওয়ামী লীগ ও দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে সোহেল রানা আহত হন। তাকে গোপালগঞ্জ ২৫০ শহর যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। একইদিন লঞ্চ ঘাট এলাকার পুরাতন সোনালী ব্যাংকের সামনে আওয়ামী লীগসহ দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে ইমন তালুকদার (১৭) নিহত হ্ওয়ার ঘটনায় হত্যা মামলা করেছেন এসআই শেখ মিজানুর রহমান। এই দুটি মামলাতে তিন হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিকশাচালক রমজান মুন্সী (৩২)। এই ঘটনাতেও একটি হত্যা মামলা হবে। রমজান মুন্সী ছাড়া অপর চার জনের লাশ সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত করা হয়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, বিলম্বে হলেও ময়নাতদন্ত করা হবে। যদিও দীপ্ত সাহার লাশ দাহ করে ফেলায় সেক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে জানা যায়নি। উল্লেখ্য, সারা দেশে মাসব্যাপী পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার গোপালগঞ্জে যান এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগে মঙ্গলবার রাতে তারা এটিকে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হিসেবে উল্লেখ করেন দলটির কয়েকজন নেতা। এরপর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এটি প্রতিহতের ঘোষণা দেন। এনসিপির নেতাদের গাড়িবহর গোপালগঞ্জে যাওয়ার পথে পথে বাধা পায়। সকালে পুলিশ এবং ইএনওর গাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের দায়ী করা হয়। দুপুরে গোপালগঞ্জের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশস্থলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। হামলার কিছুক্ষণ পর সেখানে পৌঁছান এনসিপির নেতারা। তারা সেখানে স্লোগান ও বক্তব্য দেন। সমাবেশ শেষে তারা মাদারীপুরের উদ্দেশে রওনা দিলে তাদের গাড়িবহর ঘিরে হামলা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এনসিপি নেতাদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এতে এখন পর্যন্ত পাঁচ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। ঘটনার দিন রাতেই গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা করা হয়। যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গোটা জেলাজুড়ে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে।
কারফিউয়ের পর ফের ১৪৪ ধারা : গোপালগঞ্জে ফের ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ১৪৪ ধারায় এটি জারি থাকবে। এ ধারা অনুযায়ী ওই সময় জেলার যেকোনো স্থানে যেকোনো ধরনের সভা, মিছিল বা জনসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাসেল মুন্সি বলেন, গতকাল রোববার সকাল থেকে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। চলবে রাত ৮টা পর্যন্ত। পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী, জরুরি সেবা ও সরকারি অফিস ১৪৪ ধারার আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এ সময় সভা-সমাবেশ ও একাধিক ব্যক্তির একসঙ্গে চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গত বুধবার গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় এখনও জেলার সর্বত্র বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা, জনমনে আতঙ্ক। কারফিউয়ের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জারি হলো ১৪৪ ধারা। বুধবারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর বিকালে গোপালগঞ্জ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান গোটা জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। পরবর্তীতে সেটি কারফিউতে রূপ নেয়। সেদিন থেকে দফায় দফায় বাড়ানো হয় কারফিউয়ের সময়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কারফিউয়ের সময়ে পরিবর্তন আনেন। এ সময় তিনি বলেন, শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল থাকবে। ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ কার্যকর থাকলেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে গত শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ বহাল থাকে। এরপর গত শনিবার বিকাল ৫টায় তিনি জানান, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে গত শনিবার রাত ৮টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ৬টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে কারফিউয়ের সময়। এই সময়ে শুধু জাতীয় জরুরি সেবায় নিয়োজিতরা এবং যানবাহন এর আওতামুক্ত থাকবে। এদিকে টানা কারফিউ ও ১৪৪ ধারা জারিতে বিপাকে পড়েছেন নি¤œ আয়ের মানুষসহ সাধারণ নাগরিকরা। তারা যত দ্রুত সম্ভব এ পরিস্থিতির উত্তরণ চান। উল্লেখ্য, সারা দেশে মাসব্যাপী পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার গোপালগঞ্জে যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতারা। এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে তারা এটিকে ‘লং মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ হিসেবে নামকরণ করেন। এরপর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ও ছাত্রলীগ (নিষিদ্ধ) নেতাকর্মীরা এটি প্রতিহতের ঘোষণা দেন। এরপরও গোপালগঞ্জের পৌর পার্কের উন্মুক্ত মঞ্চে সমাবেশ করেন এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা তাদের বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘কটূক্তি’ করার কারণে এই হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে বলে বলে মনে করেন গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষ। সেদিনের সংঘর্ষে নিহত হন ৫ জন। এদিকে, বুধবারের সংঘর্ষের ঘটনায় গোপালগঞ্জ সদর, কোটালীপাড়া ও কাশিয়ানী থানায় পুলিশের কাজে বাধা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ঘটনায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় প্রায় তিন হাজারের অধিক লোককে আসামি করা হয়েছে বলে জানা যায়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৩০৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button