টিকার সংকট: অর্জিত সাফল্য হারানোর মুখে বাংলাদেশের ইপিআই কর্মসূচি

স্বাস্থ্যখাতে বাংলাদেশের অন্যতম সফল উদ্যোগ হিসেবে পরিচিত সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) আজ বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। টিকা না পাওয়ার কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় শিশুদের নিয়মিত টিকাদান ব্যাহত হচ্ছে, কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্কের মতো মরণব্যাধি প্রতিরোধেও ভরসা রাখতে হচ্ছে বেসরকারি ফার্মেসির ওপর। এমন বাস্তবতা ১৯৭৯ সালে চালু হওয়া এই জাতীয় কর্মসূচির চার দশকের অর্জনের ওপর এক গভীর আঘাত। ফরিদপুর, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ দেশের অনেক জেলা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, র্যাবিক্স, পেন্টাভ্যালেন্ট, হাম, রুবেলা, পোলিও, যক্ষ্মাসহ বহু টিকার মজুত ফুরিয়ে এসেছে। নতুন করে সরবরাহ না আসায় সরকারি হাসপাতালগুলোতে আগত মানুষ ফিরছেন খালি হাতে কিংবা বাধ্য হচ্ছেন বেসরকারি টিকা কিনতে-যা অধিকাংশ নি¤œআয়ের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ এই টিকাগুলোর সঠিক সময় এবং নির্ধারিত ডোজে প্রয়োগই শিশুদের ভবিষ্যৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিশ্চিত করে। এবারের বাজেটে সরকার টিকা ক্রয়ের জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে টিকা ক্রয় ও সরবরাহে তৈরি হয়েছে সময়ঘাটতি। ইউনিসেফের মাধ্যমে টিকা আমদানির প্রক্রিয়ায় দেরির ফলে দেশের জুলাই-আগস্ট মাসের নির্ধারিত টিকা সময়মতো পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এর ফলে কয়েক লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ স্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ডোজ দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরবর্তী ডোজ না দিলে সেই টিকা কার্যকর হয় না। বর্তমানে দেশে অন্তত ১৩ শতাংশ শিশু ‘ইনভ্যালিড ডোজ’-এর শিকার। এই সংখ্যা বাড়লে শিশু মৃত্যুর হার, এমনকি মাতৃমৃত্যুও বেড়ে যেতে পারে। এটি শুধুমাত্র স্বাস্থ্য সংকট নয়-এটি একটি জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার লক্ষণ। এখানে প্রশ্ন হলো, একটি নিয়মিত ও পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির জন্য কেন প্রতি বছর বরাদ্দ ও আমদানির ক্ষেত্রে এই ধরনের অনিয়ম দেখা যাচ্ছে? ৪০ লাখ নবজাতকের টিকা নিশ্চিত করা যে কেবল শিশু অধিকার রক্ষা নয়, বরং একটি সুস্থ প্রজন্ম গঠনের পূর্বশর্ত-তা কি রাষ্ট্র এখনো যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে? সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো বলছে, টিকা ‘পাইপলাইনে’ আছে এবং শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সংবেদনশীল এ খাতে সামান্য বিলম্বও বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কুকুরের কামড়ের মতো তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন হয় এমন ক্ষেত্রে সরকারি পর্যায়ে টিকা না থাকা মানেই মৃত্যুঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যাওয়া। জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিকে টেকসই করতে হলে এখনই প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিকল্পনা। প্রতিবছর একই সংকটে পড়লে দেশের অর্জনগুলোই ধ্বংস হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য জেলা সিভিল সার্জনদের মতামত ও ফিডব্যাককে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো শিশুদের জীবন ও ভবিষ্যৎ রক্ষার এই জরুরি ইস্যুকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেবে এবং যতো দ্রুত সম্ভব সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।