স্থানীয় সংবাদ

২৬ জুলাই খুলনা ছিল আন্দোলনে উত্তাল : পুলিশের ব্যাপক ধড়-পাকড়

স্টাফ রিপোর্টার : ডেট লাইন ২৬ জুলাই ২০২৪। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল সারাদেশ। বিভাগীয় শহর খুলনাও বাদ ছিল না আন্দোলন থেকে। তবে, ২৬ জুলাই আন্দোলনটি ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও জিরোপয়েন্ট কেন্দ্রিক। কারণ পুলিশের গণগ্রেপ্তারের কারণে শহরজুড়ে ছিল আতঙ্ক ও ভয়। ওই দিন রাতে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। গ্রেফতার করা হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাতজন নেতাকে। কথিত সহিংসতা ও নাশকতার অভিযোগ দিয়ে মামলা দায়ের করা হয় তাদের বিরুদ্ধে। এভাবেই একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে পুলিশের গ্রেফতার ও নির্যাতন এ দুয়ের মধ্য দিয়ে খুলনা শহরে অতিবাহিত হয় চব্বিশের ২৬ জুলাই।
জানা গেছে, কোটা বিরোধী আন্দোলনকে বিতর্কিত করতে তৎকালীন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শিক্ষার্থীদের নিয়ে মন্তব্যের প্রতিবাদে ২৬ জুলাই বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাদী চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে নগরীর প্রবেশপথ জিরো পয়েন্ট মোড়ে অবস্থান করেন আন্দেলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, বি এল কলেজ এর শিক্ষার্থীদের সমাগমে ব্যাপক ছাত্র সমাবেশ ছিল। প্রায় দুই থেকে তিন হাজার আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার বক্তব্যকে অপমানজনক আখ্যা দিয়ে বলেন রাজাকার, ’কোটা দিয়ে বৈষম্য নয়, বৈষম্যমুক্ত দেশ চায়’, ’আমার সোনার বাংলায় কোটা প্রথার ঠাঁয় নায়’, ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’, শিক্ষার্থীদের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ,’ ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি শ্লোগানে সড়কপথ প্রকম্পিত করে তোলে। আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী নুসরাত জাহান নামে এক শিক্ষার্থী ওই সময় বলেন, আমরা এতদিন যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলাম। রাষ্ট্রের যাদের কাছে আমাদের দাবি তারাই যদি আমাদের সাথে এমন আচরণ করেন তাহলে আমরা যাব কোথায়? শেখ হাসিনার এমন মন্তব্যের প্রতিবাদে কাল রাতেই সারাদেশের ছাত্র সমাজ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। আমরা সকল শিক্ষার্থী আজকের এ কর্মসূচি পালন করছি। শেখ হাসিনা তার ভুল বুঝে ছাত্র সমাজের দাবি মেনে নিবে বলে আমরা আশাবাদী।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন,”কোটা প্রথার সংস্কার আমাদের একান্ত দাবি। বর্তমান কোটা ব্যবস্থা যোগ্য ও মেধাবীদের উপর অবিচার করছে। আমরা যোগ্যতার ভিত্তিতে আমাদের স্থান পেতে চাই। আমাদের দাবি হল, কোটা প্রথার পুনর্বিবেচনা ও সংস্কার করা হোক, যাতে মেধাবীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হয়। আমরা দেশের উন্নতির জন্য মেধাবীদের সঠিক মূল্যায়ন চাই এবং একই সাথে পুলিশ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের যে সহিংসতা ছাত্রদের উপর চলছে এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করি”।
নর্দান ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, “শান্তিপূর্ণভাবে চলতে থাকা বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলন কে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য পুলিশ এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠী আমাদের উপর চড়াও হয়েছিল। আমরা এখনো শান্তির পথ অবলম্বন করছি, কোন ধরনের সহিংসায় জড়ানো আমাদের ইচ্ছা না। কিন্তু চলমান পরিস্থিতি গুলো র তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং কোটা সংস্কারের তীব্র দাবী জানাচ্ছি।”
এদিকে, খুলনায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতা ও নাশকতা সৃষ্টিসহ সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অর্ন্তঘাতমূলক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কথিত অভিযোগে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খুলনা মেট্রোপলিন পুলিশ (কেএমপি)’র খালিশপুর থানা পুলিশের অভিযানে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে।
তৎকালীন কেএমপির সূত্র জানান, ২৫ জুলাই রাতে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে নগরীর খালিশপুর থানাধীন ২০ নং রোডস্থ একটি বাড়ীতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা-কর্মীরা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, খালিশপুর থানাধীন ১১৩ সড়কের মোঃ আবু জাফরের ছেলে মোঃ কামরুজ্জামান (৩৩), একই এলাকার রুস্তম আলীর ছেলে এমজি সরোয়ার (৫০), সাতক্ষীরা আশাশুনি থানাধীন প্রতাপনগর এলাকার খোকন মিস্ত্রীর ছেলে মোঃ নাহিদ ইসলাম(১৯), খুলনার কয়রা থানাধীন ঘুগরাকাটি এলাকার আমজাদ মোড়লের ছেলে মোঃ আবির হোসেন (২১), বাগেরহাট রামপাল থানাধীন গৌরম্ভা এলাকার শেখ মুস্তাক আহমেদের ছেলে শেখ মুয়াজ (১৯), সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানাধীন গাবুরার মোঃ মোকাররম হোসেনের ছেলে আবু নাইম (১৯) এবং যশোর কেশবপুর থানাধীন ঝিকরা এলাকার আঃ গফফার মোড়লের ছেলে মোঃ ইকরামুল ইসলাম (৩০)। এ সময় ঘটনাস্থল হতে আরো অজ্ঞাতনামা ১০/১৫ জন পালিয়ে যায়। অভিযানে খালিশপুর ওই বাড়ীর নিচতলা হতে কথিত সরকার বিরোধী বিভিন্ন উস্কানীমূলক কথা লেখা প্রেরণা নামক ৩১টি বই, সত্যের সাক্ষ্য নামক ১টি বই, সরকার বিরোধী বিভিন্ন কার্য পরিকল্পনা লেখা ৩টি ডাইরী, ব্যক্তিগত ৯টি রিপোর্ট বই, ৮২ পৃষ্ঠার ১টি মাসিক রিপোর্ট ফরম, ২টি ল্যাপটপ, একটি টাচ ফোন এবং ২টি লোহার চাপাতি আলামত হিসেবে উদ্ধার দেখায়। পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করা হয়।
ওই সময় পুলিশ আরও জানায়, গ্রেফতারকৃতরা খুলনা মহনগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়ে আসামী মোঃ কামরুজ্জামানের নেতৃতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে দৌলতপুর থানাধীন নতুর রাস্তা মোড়ে এবং সোনাডাঙ্গা থানাধীন শিববাড়ী মোড়ে ছাত্রদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছিল। আসামীরা পরস্পর যোগসাজশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ শেষে পুনরায় খুলনা মহনগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নাশকতা, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতমূলক কাজের উদ্দেশ্যে সমবেত হয়।
অপরদিকে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় খুলনা বিভাগে ২৬ জুলাই পযন্ত ১৮টি মামলায় ২৯৯ জনের গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে খুলনা জেলায় কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতায় তিনটি মামলায় ৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যারা খুলনার বিভিন্ন ওয়ার্ড পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মী।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনার তৎকালীন সমন্বয়ক আহাম্মদ হামিম রাহাত বলেন, তৎকালীন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়ার প্রতিবাদে খুলনার শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। যার অংশ হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল- কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টে ব্লকেট করে। পরবর্তীতে ওই আন্দোলন শিববাড়ি মোড়ে নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি ও আলপনা করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button