প্রান্তিক নারীর স্বাস্থ্যসেবা: কৌশলপত্র বাস্তবায়নেই ভবিষ্যৎ নির্ভর

বাংলাদেশের প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবার ক্ষেত্রে এক চরম অসমতা বহু বছর ধরেই বিদ্যমান। বিশেষত চর, হাওর, পাহাড় ও সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকে প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এর পেছনে রয়েছে ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা, যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, বাজেট ও জনবল সংকট এবং সর্বোপরি সচেতনতার অভাব। ফলে এইসব অঞ্চলের নারীদের প্রজনন অধিকার এখনো একধরনের কল্পনালব্ধ সুবিধা মাত্র। এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর (ডিজিএফপি) ২০২৫-৩০ মেয়াদের জন্য একটি সমন্বিত পরিবার পরিকল্পনা কৌশলপত্র উন্মোচন করেছে, যা নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী উদ্যোগ। ‘দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য পরিবার পরিকল্পনা কৌশল’ শীর্ষক এই নীতিপত্রে যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হবে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ অনুযায়ী, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ৫৯% এরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগেই। এর ৩১% নারীর বিয়ে হয়েছে ১৫ বছর বয়সের আগেই। এই তথ্য শুধু আগাম মাতৃত্বের ঝুঁকিই নয়, বরং অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যাশিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ঝুঁকির গভীরতাকেও প্রকাশ করে। তার ওপর দুর্গম এলাকায় পরিবার পরিকল্পনার ‘অপূর্ণ চাহিদার হার’ অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে উচ্চ। কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত পরিকল্পনাগুলো যেমন-সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো গড়ে তোলা, প্রশিক্ষিত ধাত্রী ও এফডব্লিউভি নিয়োগ, ওষুধ ও গর্ভনিরোধক সরঞ্জামের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, স্থানীয়দের সচেতনতা বৃদ্ধি ও অংশগ্রহণ, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব-এসবই সঠিক পথে যাত্রার নির্দেশনা দেয়। বিশেষ করে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, প্রজনন অধিকার ও পছন্দের স্বাধীনতার বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া কৌশলপত্রটিকে আরও মানবিক ও অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিকোণে উপস্থাপন করেছে। তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ মোটেই সহজ নয়। স্পিডবোটে চলাচল, দুর্বল ক্লিনিক কাঠামো, স্থানীয় ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা, পর্যাপ্ত জনবল ও অর্থায়নের অভাব-এসব বাধা এখনো বহাল। এতে যে বড় চ্যালেঞ্জটি সামনে আসছে তা হলো টেকসই অর্থায়ন, দক্ষ জনবল নিশ্চিতকরণ ও কার্যকর তদারকি ব্যবস্থা। কৌশল কাগজে থাকলে চলবে না, সেটিকে মাঠপর্যায়ে বাস্তব ও কার্যকর করতে না পারলে প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্যে যেমন প্রতিশ্রুতির ছাপ রয়েছে, তেমনি স্বীকারোক্তিও রয়েছে যে এই প্রস্তুতি আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল। এখন যেহেতু কৌশলপত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন সম্পন্ন হয়েছে, দেরিতে হলেও তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই এই উদ্যোগের সার্থকতা প্রমাণ করতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল সেবা, অ্যাপভিত্তিক তথ্যপ্রবাহ, মোবাইল ক্লিনিক ও ড্রোনভিত্তিক ওষুধ সরবরাহের মতো উদ্ভাবনী চিন্তা কার্যকর করাও এখন সময়ের দাবি।
