সম্পাদকীয়

নতুন প্রেক্ষাপট, পুরোনো অনিশ্চয়তা: রাজনীতি ও অর্থনীতির দুই মুখ

রাজনৈতিক পালাবদলের এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। পরিবর্তনের পর প্রত্যাশা ছিল, রাজনীতি স্থিতিশীল হবে, অর্থনীতিতে আস্থা ফিরবে, বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, আর সর্বোপরি-দেশ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এগোবে। কিন্তু এই প্রত্যাশাগুলোর বেশিরভাগই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং রাজনীতি ও অর্থনীতি-উভয় অঙ্গনেই অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সংবিধান সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচনব্যবস্থার পুনর্গঠন কিংবা আর্থিক খাতের পুনর্বিন্যাস নিয়ে যেসব সংলাপ ও আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল, তা এখন কার্যত থমকে গেছে। বড় দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্যের অভাব এবং আস্থার সংকট দেশের রাজনীতিকে একটি চরম অনির্দেশ্য অবস্থায় এনে ফেলেছে। এর প্রভাব শুধু রাজনীতিতে নয়, অর্থনীতিতে গিয়ে ঠেকেছে আরও গভীরভাবে। আর্থিক খাতের ছবি আরও হতাশাজনক। ব্যাংক খাতে তারল্য ঘাটতি নেই-বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন তাই বলছে। কিন্তু ঘাটতি রয়েছে আস্থার। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার নিট উদ্বৃত্ত তারল্য থাকলেও তা মাঠে নেই, আটকে আছে হিসাবপত্রে। কারণ, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, রাজনৈতিক দৃশ্যপট অনিশ্চিত, বাজার অস্থির। ফলে উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। ব্যাংকগুলোর প্রতি জনগণের বিশ^াস কমে গেছে। বিশেষ করে কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের স্বচ্ছতা ঘাটতি গোটা ব্যবস্থার ওপরই নেতিবাচক ছাপ ফেলেছে। তীব্র অচলাবস্থার আরেকটি উদাহরণ হলো-মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়া। যা মূলত শিল্প ও উৎপাদন খাতের স্থবিরতা এবং নতুন বিনিয়োগ না হওয়ারই পরোক্ষ ইঙ্গিত। দেশের বিভিন্ন খাতে কারখানা বন্ধ হয়েছে, হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। নতুন শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ফলে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির গতি মন্থর করে দিচ্ছে। অবশ্য কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে। রেমিট্যান্স বেড়েছে, বৈদেশিক সাহায্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভও খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ডলারের বাজারে চাপ কমেছে এবং টাকার মান কিছুটা হলেও শক্তিশালী হয়েছে। তবে এসব ইতিবাচক দিক এখনো নড়বড়ে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। মূলধনি পণ্য আমদানি না বাড়লে অর্থনীতির এই সাময়িক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা কঠিন হবে। এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন দাঁড়ায়: সমাধান কোথায়? অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের বিশ্লেষণে একটিই কথা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বৈধ ও আস্থাসম্পন্ন সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই পারে এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। রাজনৈতিক বৈধতা ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা ছাড়া পুঁজি মাঠে নামাতে চায় না। সেই আস্থার সংকট এখন সবচেয়ে বড় বাধা। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতির এই দ্বৈত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর প্রশাসনিক উদ্যোগ এবং একটি বাস্তবমুখী অর্থনৈতিক কর্মপরিকল্পনা। কেবলমাত্র বাজেট ঘাটতি কমিয়ে বা বৈদেশিক সাহায্য বাড়িয়ে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না, বরং একটি নির্ভরযোগ্য, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই গতি ফিরবে রাজনীতিতে, আস্থা ফিরবে অর্থনীতিতে।

 

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button