স্থানীয় সংবাদ

কয়রায় বিলুপ্তির পথে আদিবাসীদের মাতৃভাষা সংরক্ষণে পৃষ্টপোষকতা দরকার

# আজ বিশ্ব আদিবাসী দিবস #

রিয়াছাদ আলী, কয়রা (খুলনা) ঃ আগে আমাদের ছেলে মেয়েরা আমাদের ভাষায় কথা বলতো, বর্তমানে সকল ছেলে মেয়েরা আমাদের অনেক ভাষা বুঝতে চায় না।
এখন কালের বির্বতনে তা হারিয়ে যেতে বসেছে। এটি এখনও সংরক্ষন করে রাখা না হলে আগামী দু পাঁচ বছরে নিজস্ব ভাষা হারিয়ে যাবে। এমন কথাগুলো বলেছেন কয়রা উপজেলার ৬নং কয়রা (টেপাখালী) গ্রামের নিলকান্ত মুন্ডা। শুধু নীলকান্ত মুন্ডা নয় এমন কথাগুলো জানালেন অনেক আদিবাসী মুন্ডা ও মাহতো সম্প্রদায়ের সদস্যরা। তারা তাদের নিজস্ব ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে চায়। খুলনার কয়রা উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মুন্ডা সম্প্রদায়ের দেড় হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। মুন্ডাদের নিজস্ব ভাষা ‘মুন্ডারি’। কিন্তু এর কোনো লিখিত রূপ নেই, কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে বর্ণমালা। শুধু মুখে মুখে প্রচলিত কথ্য ভাষাও আজ বিলুপ্তির পথে।

বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তাদের ভাষা বুঝতে চায় না। যে কারনে আদিবাসী সদস্যরা তাদের নিজস্ব ভাষা টিকিয়ে রাখতে সরকারের নিকট সাহায্যর দাবি জানিয়েছে। কয়রা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত বেশ কয়েকজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনো ধরনের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মাতৃভাষা। ভাষা রক্ষায় তাঁদের শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিসহ ভাষা সংরক্ষণ, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তারা। কয়রা সদরের নলপাড়া গ্রামে মুন্ডা শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতে একটি বেসরকারি সংস্থা ‘মুন্ডা বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি বিদ্যালয় গড়ে তোলে। তবে তাদের প্রকল্প শেষ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে আর্থিক সংকটে তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। ঐ বিদ্যালয়ে এখানকার আদিবাসী শিশুদের লেখাপড়া শিখানো হতো। বিদ্যালয়টির সাবেক শিক্ষক শায়ন্তি মুন্ডা জানান, তিনি তার স্কুলে মুন্ডারি ভাষায় নয়, বাংলা ভাষায় মুন্ডা শিশুদের লেখাপড়া শেখাতো । এতে কিছুটা সমস্যা হলেও বাধ্য হয়ে মানিয়ে নিতে হয়েছে। তবে তিনি অভিমত ব্যাক্ত করতে গিয়ে বলেন, ঐ স্কুলে মুন্ডারি ভাষা প্রচলন হলে লেখাপড়ার অংশ নেওয়া শিশুদের হার আরও বৃদ্ধি পেতো। তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব ভাষার কোনো বই নেই। ইন্টারনেট বা উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে মুন্ডাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। মুন্ডারি ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। তা না হলে এ ভাষা একসময় আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে। উপজেলার নলপাড়া গ্রামের সাধনা মুন্ডা বলেন, ‘মাতৃভাষা ধরে রাখার জন্য আমরা নিজেরা বাড়িতে সব সময় মুন্ডারি ভাষায় কথা বলি। তবু আমাদের ভাষা রক্ষা করা যাচ্ছে না। বাংলার সঙ্গে ক্রমেই মিশে যাচ্ছে। মুন্ডা শিশুদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে আগামী প্রজন্ম হয়তো এই ভাষা হারিয়ে ফেলবে। উপজেলার উত্তর বেদকাশী এলাকার বলয় মুন্ডা জানান, তিনি তার সন্তানদের সঙ্গে মুন্ডারি ভাষায় কথা বললেও তারা বাংলা ভাষায় উত্তর দেয়।
খুলনা জেলা আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নিরাপদ মুন্ডা বলেন, ‘আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বাংলা ভাষা জানতাম না। স্কুলে যাওয়ার পর বাংলা ভাষা শিখেছি। স্কুলেও আমাদের ভাষা প্রয়োগ হয় না। এতে আমাদের ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে।’ তিনি জানান, মুন্ডারি ভাষা ভারতীয় আর্যভাষা থেকেও প্রাচীন। মুন্ডারি ভাষার চর্চা না থাকায় দিন দিন এ ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ ভাষায় শিশুদের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হলে ঝরে পড়ার হার অনেক কমে যেত। মুন্ডারি ভাষা সংরক্ষণের দাবি জানান এই আদিবাসী নেতা। কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ চলমান রয়েছে । ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাদের ভাষা সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোজখবর নিয়ে তিনি যথাযথ উদ্যোগ গ্রহন করবেন বলে জানান।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button