খুলনায় ব্যবসায়ীদের মহররমের আয়োজন নিয়ে ধু¤্রজাল সৃষ্টি

# দেওয়া হলো না মাদ্রাসা ও এতিমখানায় খাবার
স্টাফ রিপোর্টার ঃ প্রথমে বলা হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার স্থানে গরু জবাই দিয়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। সনাতনী নেতারা বললেন, আয়োজনে আমাদের কোন আপত্তি নাই। সাথে সাথে পয়দা হলো নতুন ইস্যু। ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে পলাতক আওয়ামী লীগ ছদ্মবেশে কাঙ্গালী ভোজের পায়তারা করছে। এ নিয়ে হই-হট্টোগোল আর চরম উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে আয়োজনের সব উপকরণ জব্দ করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এভাবেই মব সৃষ্টি করে খুলনার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র বড় বাজারে মহররম উপলক্ষে দোয়া ও তবারক বিতরণ আয়োজন পন্ড করা হয়েছে। বুধবার (১৩ আগস্ট) রাতে নগরীর বড় বাজার হেলাতলা রোডে এ ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার ( ১৪ আগস্ট) দুপুরে থানা থেকে জব্দকৃত মালামাল ফেরৎ নিয়ে যান আয়োজকরা। সেখানে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় সবাই উপস্থিত ছিলেন। এক বাক্যে সবাই বলছেন, আমাদের ভেতরে কোন বিভেদ বা সমস্যা নেই। তাহলে কে বা কারা এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো, এ প্রশ্নের জবাব দেননি তাদের কেউ। ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা একাধিক ভিডিও ক্লিপ ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে খুলনা সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা ফরিদ আহমেদ আয়োজনের বিরোধিতা করে উচ্চকন্ঠে বক্তৃতা করছেন। শেখ মুজিবের মৃত্যু বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে কতিপয় আওয়ামী লীগের লোকজন এই আয়োজন করেছে বলে অভিযোগ তার। বক্তৃতার সময় তার পাশে দাঁড়ানো ছিলেন খুলনা মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বরত শরিফুল ইসলাম টিপু। ফরিদ মোল্লার পাশে উপস্থিত লোকজনকে উত্তেজিত ভঙ্গীতে নানা শ্লোগান দিতে দেখা যায়। স্বর্ণ ব্যবসার কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত হেলাতলা এলাকার একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মহররম মাসে এখানে ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে একটি মাহফিল ও তবারকের আয়োজন করা হতো। পাশাপাশি হেলাতলায় প্রচুর সংখ্যক হিন্দু ব্যবসায়ী থাকায় তারাও কাউন্সিলরের মোড়ে প্রতি বছর সাড়ম্বরে দূর্গা পুজার আয়োজন করেন। দেশে কিংবা দেশের বাইরে যে কোন পরিস্থিতিতেও এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে সম্প্রীতি বিনষ্টের কোন ঘটনা ঘটেনি। গত ৩ আগস্ট স্বর্ণপট্টি ইসলামি এস্তেজামিয়া কমিটি গঠন করে সিদ্ধান্ত হয় ১৪ তারিখ বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা এবারের আয়োজন করবেন। সে অনুযায়ী সব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অনুদান নিয়ে কেনাকাটা করা হয়। জানা গেছে, বুধবার রাত ৯টার দিকে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি থেকে কিছু পুলিশ সদস্য এসে রাস্তার ওপর গরু জবাই করা যাবেনা বলে নিদের্শ দেয়। তারা বলেন, এখানে হিন্দুদের পুজা হয়। ফলে গরু জবাই দিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে পারে। এ নিয়ে আয়োজকদের সাথে মতভেদ সৃষ্টি হলে কয়েকজন সেখানেই গরু জবাইয়ের সিদ্ধান্তে শক্ত অবস্থান নেন। সেখানে অনেক লোক জড়ো হলে এক পর্যায়ে সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা ফরিদ আহমেদ ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, এখানে আওয়ামী পন্থীরা ১৫ আগস্ট উপলক্ষে কাঙ্গালী ভোজের আয়োজন করছে। উত্তেজনা ও বাকবিতন্ডার এক পর্যায়ে ৪/৫ জনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। পুলিশ সেখান থেকে একটি গরু ও ডেকোরেটর সামগ্রী থানায় নিয়ে যায়।
স্বর্ণপট্টি ইসলামী এস্তেজামিয়া কমিটির সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের দাদা, বাবা, চাচাদের আমল থেকে হেলাতলায় নিয়মিত এই আয়োজন হচ্ছে। এবার কারা কেন এই প্রপাগান্ডা ছড়ালো বুঝছি না। এখানে হিন্দু মুসলমানে কখনোই দূরত্ব ছিলনা, একে অপরের ধর্মীয় আয়োজনে সহায়তা করি। আমাদের কমিটিতে আওয়ামী লীগের কেউ নেই। গত জুলাইয়ের পরে আমরা ১৫ আগস্টই ভুলে গেছি। মনে থাকলে হয়তো আজ আয়োজন করতাম না। থানায় যেসব মালামাল নিয়ে গিয়েছিল তা ফেরৎ এনেছি। পরে আলোচনা করে অনুষ্ঠানের নতুন তারিখ নির্ধারণ করবো। তিনি আফসোস করে বলেন, আজকে খুলনার আলিয়া মাদ্রাসা, দারুল উলুম মাদ্রাসা, সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসা, খালাসি মাদ্রাসা, রেলওয়ে মাদ্রাসা ও এতিমাখানা সহ অনেক গুলো বড় ছোট মাদ্রাসায় দুপুরে এতিমদের মাঝে তবারক বিতরণ করবো বলে জানিয়ে এসেছিলাম। তাদেরকে খাবার দিতে পারলাম না। খুলনা জেলা জুয়েলার্স মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শংকর কর্মকার বলেন, মহররম উপলক্ষে এই অনুষ্ঠান আয়োজনে আমাদের পক্ষ থেকে আপত্তি বা বিরোধিতার কোন প্রশ্নই ছিলনা। তাহলে কেন কারা এ ঘটনা ঘটালো, সম্প্রীতি বিনষ্টের কথা তুললো বুঝতে পারছিনা।
নগরীর আলকাতরা মিল মোড়ের মডার্ণ ডেকোরেটরের বাবুর্চি মো: আফসার গাজী বলেন, বহু বছর ধরে এই অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ করি। ২০২০ সালে করোনার পর থেকে এই কয় বছর বন্ধ ছিল। তিনি জানালেন, পুলিশ একটা বিশাল সাইজের এড়ে গরু, ২২ টা ডেগ, গামলা সহ আরও কিছু উপকরণ থানায় নিয়ে গেছে। রান্নার জন্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আলু কাটা বাছা হয়ে গেছিলো। সেগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।
সদর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোল্লা ফরিদ আহমেদ জানান, মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বরত টিপু (শরিফুল ইসলাম টিপু) রাত ৯টার দিকে ফোন দিয়ে ঘটনা জানায়। কিছু সময়ের মধ্যে বলে আপনি আসেন, এখানে বড় ঝামেলা হচ্ছে। আমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে বিশ্রামে আছি। সেই অবস্থায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি আওয়ামী মনোভাবাপন্ন লোকজন মহররমের নামে মূলত ১৫ আগষ্ট পালন করবে। আমরা চ্যালেজ্ঞ করলে তারা দৌঁড়ে পালাতে গেলে কয়েকজনকে ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেই। তার দাবি, এখানে কখনোই মাহফিল হতোনা। বরং হিন্দুরা সেখানে বড় আয়োজনে পুজা করে।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার সনোয়ার হোসাইন মাসুম বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মহররম উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। করোনায় কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর এবার আবার বড় করে আয়োজন করে। গতকাল (বুধবার) রাতে এ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হলে আমি ঘটনাস্থলে যাই। তাদেরকে বলি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গরু জবাইয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গা আছে। আপনারা রাস্তায় গরু জবাই দিতে পারবেন না। আর হেলাতলা খুব গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম একটা ব্যবসা কেন্দ্র। এখানে দুপুর বেলায় রাস্তার ওপর প্যান্ডেল করে অনুষ্ঠান করলে সবার জন্য সমস্যা হবে। তিনি দাবি করেন, সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের মতো কিছু ঘটেনি। আয়োজকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ করা কাউকে আমি পাইনি। যেহেতু ১৫ আগস্ট সেনসিটিভ একটা তারিখ। তারা পরবর্তী একটা তারিখ দেখে আয়োজন করবে।