শরণখোলার বেড়িবাঁধ-৩০০ কোটির প্রকল্প, ১৮ মাসেই ভাঙন

বাগেরহাটের শরণখোলায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে-এ খবর শুধু উদ্বেগজনক নয়, বরং দেশের অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের মান ও জবাবদিহি নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলে। বলেশ^র নদের তীরে সাত বছর ধরে নির্মিত ৩৫/১ পোল্ডারের বাঁধ হস্তান্তরের ১৮ মাসের মধ্যেই তছনছ হয়ে যাওয়া উন্নয়ন খাতে দুর্বলতা, তদারকির অভাব এবং নকশাগত ত্রুটির স্পষ্ট প্রমাণ। বিশ^ব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল উপকূলীয় জনগণকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা থেকে টেকসই সুরক্ষা দেওয়া। কিন্তু নির্মাণকাজে নদীশাসনকে উপেক্ষা করা, মাটির বদলে বালু ব্যবহার এবং ত্রুটিপূর্ণ ব্লক বসানোর কারণে বাঁধ গোড়া থেকেই ভাঙতে শুরু করেছে। আজ শরণখোলার বগী, গাবতলা, তাফালবাড়ী, রাজেশ^র, বড়ইতলা, খোন্তাকাটা থেকে মোরেলগঞ্জের সন্ন্যাসী পর্যন্ত কমপক্ষে ১০টি স্থানে বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে। প্রতি বছর নতুন নতুন এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ছে। এই অবস্থায় স্থানীয় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলছেন-৩০০ কোটি টাকা খরচ করেও যদি বাঁধ টেকসই না হয়, তবে এর দায় নেবে কে? ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কারসাজি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, কিংবা তদারকির ব্যর্থতা-সবই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। জনগণের করের অর্থ এবং আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তা এভাবে অকার্যকর হয়ে গেলে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত জনপদই নয়, পুরো দেশের উন্নয়ন ভাবমূর্তিই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময়ই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, শরণখোলা ভৌগোলিকভাবে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। এখানে শুধু বাঁধ নির্মাণ যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি নদীশাসন অপরিহার্য। অথচ সেই সতর্কবার্তা উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফল আজ ঘূর্ণিঝড় রিমালসহ অতিবৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে ভয়াবহ ভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মেরামতের জন্য নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-আরও কত টাকা খরচ হবে, আর কত বছর লাগবে? মানুষের জীবিকা, ঘরবাড়ি ও নিরাপত্তা এভাবে পরীক্ষার উপকরণ হতে পারে না। জরুরি ভিত্তিতে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি নদীশাসন পরিকল্পনা ছাড়া এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো জবাবদিহি নিশ্চিত করা। কেন সাত বছরের কাজ ১৮ মাসেই অকার্যকর হলো, কারা দায়ী-তা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বের করতে হবে। আন্তর্জাতিক ঋণ সহায়তায় বাস্তবায়িত প্রকল্প ব্যর্থ হলে শুধু রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি নয়, উন্নয়ন সহযোগীদের আস্থাও ক্ষুণ্ণ হয়। শরণখোলার বেড়িবাঁধ ভাঙন শুধু একটি অবকাঠামো ব্যর্থতা নয়, এটি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায়। জনগণ সুরক্ষার নিশ্চয়তা চাইছে, আশ^াস নয়। এখন সময় এসেছে টেকসই পরিকল্পনা, কঠোর তদারকি এবং প্রকৃত দায়ীদের জবাবদিহির। নইলে “উন্নয়ন প্রকল্প”নামেই আরও ভাঙনের গল্প লিখতে হবে।
