জনরোষে ধ্বংসস্তূপ খুলনার শেখ বাড়ি কোলাহলপূর্ণ বাড়ি এখন নির্জন নিরবতা

# দালালরা ভোল পাল্টিয়ে বহাল তবিয়তে ঘুরছে #
স্টাফ রিপোর্টার ঃ খুলনার অভিশপ্ত ‘শেখ বাড়ি’ এক সময় মধ্যরাত পর্যন্ত সরগরম থাকত। বাড়ির সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত বিলাসবহুল গাড়ি। রাস্তায় থাকত পুলিশের সরব উপস্থিতি। বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেও যেন ভয় লাগত সাধারণ মানুষের। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল এ অঞ্চলের সব ক্ষমতার কেন্দ্র। এই বাড়ির লোকজনের হুকুমেই চলত আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি গঠন থেকে শুরু করে দক্ষিণাঞ্চলের সব রাজনৈতিক দলের কর্মকা-। খুলনা নগরীর শেরেবাংলা রোডে সাবেক প্রধানমন্ত্রী গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার চাচা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই শেখ আবু নাসেরের বাড়ি এটি। আ’লীগ ক্ষমতায় আসার পর দোতলা বাড়িটি পরিচিতি পায় ‘শেখ বাড়ি’ হিসেবে। এখন বন জঙ্গল আর পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মুখে ২০২৪ সালের ৪ ও ৫ আগস্ট কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে শেখ বাড়িতে। এরপর থেকে বাড়িটি ‘পোড়া বাড়ি’ হিসেবে পড়ে রয়েছে। কোলাহল পূর্ন বাড়িটি এখন নির্জন পরিবেশ বিরাজ করছে। ৫ ফেব্রুয়ারি’২৫ খুলনার সেই ‘শেখ বাড়ি’ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। শেখ বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র-জনতা ঘোষণা দিয়ে রাত ৯টা থেকে ভাঙচুর চালান। অনেকে রড-হাতুড়ি দিয়ে বাড়ির প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্র-জনতা ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই’, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বক্তৃতা করবেন, এমন ঘোষণার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা খুলনার শেখ বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, শেখ বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের দাপটে শেখ বাড়ি থেকে খুনি হাসিনার চাচাতো ভাইয়েরা মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন করেছেন। তারা জবরদখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোবাজি, জুলুম-নির্যাতন, অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়, ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে অপরাধলব্ধ বিপুল অর্থে সহায় সম্পদ গড়েছেন। কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। চৌদ্দ পুরুষের সারাজীবন বসে খাওয়ার মতো সম্পদ তারা গড়ে নিয়েছেন। সব অপকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শেখ বাড়ি। এই বাড়ির ওপর মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে তাদের আরেক সহযোগি খালিশপুরের ফয়েজ আহমেদ পালিয়ে গেলেও তার স¤্রাজ্য রয়েছে অক্ষত। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির এক শীর্ষ নেতা ফ্যাসিস্ট ফয়েজের আতœীয় হওয়ায় তার বাড়ির দিকে কেউ নজর দিতে সাহস পায়নি। খুনি শেখ হাসিনার পাঁচ চাচাতো ভাই হলেন-শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল। তাদের মধ্যে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল সংসদ সদস্য ছিলেন। একই পরিবারের আরেকজন সংসদ সদস্য ছিলেন, শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়। সবাই ঢাকায় থাকলেও খুলনায় এসে থাকতেন এই পৈতৃক বাড়িতে। বাড়িকে ঘিরে যেসব কার্যকলাপ হতো, তা কেবল মাফিয়া ডনদের নিয়ে নির্মিত সিনেমাতেই দেখা যায়। ওই বাড়ি থেকেই মূলত পদ্মার এপারের আ’লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হতো। খুলনাঞ্চলের সব ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ, মনোনয়ন-বাণিজ্য, চাকরির নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু চলত এই বাড়ি ঘিরে। সরকারি জনবল নিয়োগে ‘শেখ বাড়ি কোটা’ বলে একটা প্রথা চালু ছিল। হেলাল কিংবা তার ভাইদের কারও কেন্দ্রীয় বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ ছিল না। তবে দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে হলে তাদের সমর্থন থাকতে হতো। বিরোধী ও ভিন্ন মত দমন এবং দুর্নীতি-অনিয়ম সবই হতো হাসিনার চাচাতো ভাইদের নির্দেশে। তবে তারা পালিয়ে গেলেও তাদের অন্যতম শীর্ষ সহযোগি চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি কাজী আমিনের সকল স্থাবর অস্থাবর রয়েছে নিরাপদে। খুলনা মহানগরীর বিএনপির কতিপয় শীর্ষ নেতাদের সুবিধা দিয়ে তিনি তার সম্পদ অক্ষত রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট’২৪ আ’লীগ সরকারের পতন ঘটে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা ওই দিনই ভারতে পালিয়ে যান। এরপর দ্রুত আত্মগোপনে চলে যান দেশে থাকা আ’লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও এমপি-মন্ত্রীরা। আত্মগোপনে চলে যান তার চাচাতো ভাইয়েরাও। শেখ বাড়ির লোকেরা খুলনা বিভাগের সর্বময় কর্তা ছিলেন। তাদের মধ্যে দু’জন বিনাভোটের নির্বাচনে সংসদের এমপি ছিলেন। তারা হলেন-শেখ হেলাল উদ্দিন ও সেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দু’ সংসদের এমপি। হেলাল ও তন্ময় ভারতের কলকাতায় আছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পরে জুয়েল দেশে ছিলেন। পরে তিনিসহ তাদের আরও তিন ভাই শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল কলকাতায় চলে যান। আত্মগোপনে থাকার দু’ মাস পর মুখ খুলেছিলেন সাবেক বিসিবির পরিচালক শেখ সোহেল। ৮ অক্টোবর’২৪ রাতে নিজের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোস্ট করেন তিনি। বর্তমানে এই ৫ ভাইয়ের নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে। এমন কি সালাহ উদ্দীন জুয়েল ভারতে তার নাম ও পিতার নাম ঠিকানা পরিবর্তন করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য হয়ে বসবাস করছেন। যা প্রকাশ পাওয়ার পর খুলনার আওয়ামী ভক্তরা খুবই বিভ্রত হয়। নাগরিক নেতা শাহ লায়েক উল্লাহ বলেন, গত সাড়ে ১৬ বছর শেখ বাড়িটি ছিল এক অভিশপ্ত নাম। এমন কোন খারাপ কাজ ছিল না যা এখানে হতো না। পুরো খুলনাবাসী ছিল এই পরিাবরের কাছে জিম্মি। ক্ষমতার অপব্যবহার কাকে বলে তার সংজ্ঞা ছিল এই বাড়িকে কেন্দ্র করে। তারা পালিয়ে গেলেও তাদের সহযোগি বা দালালরা ভোল পাল্টিয়ে এখনও শহর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে এই নাগরিক নেতা মনে করেন। ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা চা বিক্রেতা মুসলিম জানান, শেখ বাড়ি এখন পরিত্যক্ত বাড়ি। এখানে কুকুর আর ভুত পেতনীর আড্ডাখানা হয়েছে। বন জঙ্গলে ভরে গেছে বলে তিনি জানান।