বিনিয়োগ স্থবিরতায় ব্যাংক খাতের ঝুঁকি

দেশের ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে, কিন্তু বিনিয়োগের গতি কমে যাওয়ায় এই প্রবৃদ্ধি এখন ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা-যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৭.৭৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু একই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.৪ শতাংশে, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো অর্থ সংগ্রহ করছে বটে, কিন্তু তা উৎপাদনশীল খাতে প্রবাহিত হচ্ছে না। অর্থনীতির জন্য এটি উদ্বেগজনক সংকেত। কারণ ব্যাংকের মূল কাজ হলো সঞ্চিত অর্থকে বিনিয়োগে রূপান্তর করা। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান তৈরি হয় না, শিল্প সম্প্রসারণ হয় না, রাজস্ব আয়ও কমে যায়। এর প্রভাব পড়ে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করে আসছেন, ব্যাংকে অতিরিক্ত আমানত থাকলেও যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার না হয়, তাহলে মুনাফা দিতে হিমশিম খেতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডার-দু’পক্ষই। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, শ্রমবাজারে অস্থিরতা ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ভাটা-এসব কারণ মিলিয়েই বিনিয়োগে এই খরা তৈরি হয়েছে। উপরন্তু, কিছু দুর্বল ব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের অভিযোগে তাদের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার পর থেকে অনেক গ্রাহক তুলনামূলক ভালো ব্যাংকে আমানত স্থানান্তর করছেন। যদিও এতে কিছু শক্তিশালী ব্যাংকের ওপর আস্থা বেড়েছে, সামগ্রিকভাবে খাতজুড়ে অস্থিতিশীলতা থেকেই যাচ্ছে। একটি ইতিবাচক দিক হলো, আমানতকারীরা এখন কেবল উচ্চ সুদ নয়, বরং সুশাসন ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তাকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে সুদের হার উন্মুক্ত হওয়ার পর কিছু ব্যাংক ১৩ শতাংশের বেশি দিচ্ছে, অথচ বিনিয়োগ না বাড়ায় তা টেকসই হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সতর্ক করে বলেছে, অতিমাত্রায় আমানত সংগ্রহ কোনো ব্যাংকের জন্যই লাভজনক নয়, বরং ঝুঁকিপূর্ণ। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও হয়রানিমুক্ত ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও উৎপাদনমুখী শিল্প ও উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিতে হবে, যাতে তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হন। পাশাপাশি ব্যাংক খাতের দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করে আস্থা ফেরাতে হবে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি আরও কঠোর করা জরুরি। আমরা ভুলে গেলে চলবে না, ব্যাংক খাত শুধু আর্থিক ব্যবস্থার ভিত্তি নয়; এটি কর্মসংস্থান, শিল্প ও সামগ্রিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। বিনিয়োগ স্থবির থাকলে অর্থনীতির গতি শ্লথ হবে, আর আমানত বৃদ্ধির সুফল কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। তাই এখনই প্রয়োজন কার্যকর উদ্যোগ, যাতে ব্যাংক খাতে সঞ্চিত অর্থ দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করতে কাজে লাগে।
