সম্পাদকীয়

ডেঙ্গুতে মৃত্যুহারে শীর্ষে: কোথায় ঘাটতি, কী হবে করণীয়

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার করুণ চিত্র আবারও উন্মোচিত হলো। আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ সপ্তম হলেও মৃত্যুহারে শীর্ষে অবস্থান করছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর আগস্ট পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার ০.৫২ শতাংশ, যা বিশে^র সর্বোচ্চ। অথচ ইন্দোনেশিয়ার মতো ডেঙ্গুপ্রবণ দেশে মৃত্যুহার ০.৪১ শতাংশের নিচে। এই বাস্তবতা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রস্তুতির ঘাটতি এবং জনসম্পৃক্ততার অভাবের প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত্যুহার বেশি দেখানোর একটি কারণ হলো তথ্য সংগ্রহের সীমাবদ্ধতা। দেশে কেবল হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্যই নথিভুক্ত হয়, ঘরে চিকিৎসা নেওয়া বিপুলসংখ্যক রোগী এই হিসাবের বাইরে থাকে। তবু এটিই পুরো ব্যাখ্যা নয়। প্রকৃত কারণ হলো-রোগী দেরিতে হাসপাতালে আসছে, প্রাথমিক চিকিৎসার ঘাটতি রয়েছে, আর রাজধানী ও জেলার বাইরে স্বাস্থ্যসুবিধার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়ে গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, ৫৭ শতাংশের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তির প্রথম দিনেই মারা যায়। অর্থাৎ, রোগী যখন পৌঁছায়, তখন অবস্থা ইতিমধ্যেই জটিল হয়ে পড়ে। আরেকটি বড় ঘাটতি হলো মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ব্যর্থতা। ডেঙ্গু মোকাবিলায় নিয়মিত ফগিং, লার্ভিসাইড ব্যবহার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জনসচেতনতা তৈরির মতো পদক্ষেপ যথেষ্ট হয়নি। ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো একে অপরের ওপর দায় চাপালেও কার্যকর ফলাফল মেলেনি। ফলে প্রজনন মৌসুমে এডিস মশার বিস্তার ঠেকানো যায়নি। ডেঙ্গু প্রতিরোধে শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওপর দায় চাপানো যথেষ্ট নয়। এখানে সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে একটি সমন্বিত রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় প্রাথমিক পর্যায়ে কীভাবে রোগী শনাক্ত ও ব্যবস্থাপনা করা যায়, সে বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও ওষুধ-সরঞ্জামের সহজলভ্যতাও জরুরি। এ ছাড়া ডেঙ্গুর ধরন বা ভেরিয়েন্ট বদলে যাওয়ার বিষয়েও গবেষণা ও নজরদারি বাড়াতে হবে। রাজধানীতে ভেরিয়েন্ট-৩-এর বাড়তি প্রাদুর্ভাব সতর্ক সংকেত দিচ্ছে। তাই ভাইরাসের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা প্রটোকল হালনাগাদ করা অপরিহার্য। বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগ নয়, বরং সারাবছরের ঝুঁকি। মৃত্যুহারে বিশে^র শীর্ষে অবস্থান আমাদের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা। এখনই যদি সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে আগামী মৌসুমে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। জনসচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা এবং বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা করাই হবে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button