টঙ্গীতে রাসায়নিক গুদাম: ঝুঁকির মাঝেই জনজীবন

শিল্পশহর টঙ্গী এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি-আবাসিক এলাকা, মার্কেট, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরেও রাসায়নিক গুদাম বসিয়ে ব্যবসা চলছে। এই ব্যবসা যেমন জননিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে, তেমনি প্রতিটি অগ্নিকা-ই প্রাণহানির দুঃসংবাদ বয়ে আনছে। সম্প্রতি সাহারা মার্কেটে ফেমাস কেমিক্যাল গুদামে অগ্নিকা-ে চারজনের মৃত্যু প্রমাণ করছে, সমস্যাটি আর অবহেলা করার মতো নয়। বিদ্বেষের বিষয় হলো, সরকারিভাবে বিপজ্জনক রাসায়নিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তা কার্যত ব্যর্থ। চুড়িহাট্টার মর্মান্তিক ঘটনার পর ৯৩ কোটি টাকার ব্যয়ে টঙ্গীর কাঁঠালদিয়ায় ৫৩টি আধুনিক গুদাম নির্মিত হয়। অথচ বিজ্ঞপ্তি ও চিঠি দেওয়ার পরও কোনো ব্যবসায়ী এখনো সেখানে গুদাম নিতে আগ্রহ দেখাননি। নিরাপদ গুদাম ফাঁকা পড়ে থাকা অবস্থায় অবৈধভাবে জনবহুল এলাকায় রাসায়নিকের ব্যবসা চলতে থাকাটা এক ধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবেই ধরা যায়। প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, গাজীবাড়ি, চম্পকালি সিনেমা হল রোড, তিতাস গ্যাস রোড, আমতলী কিংবা সমবায় কমপ্লেক্স-সব জায়গাতেই রাসায়নিক ড্রাম স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ফুটপাত পর্যন্ত দখল করে রাখা ড্রাম জনসাধারণের চলাচলকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, অনেক গুদামে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই। যে কোনো সময় অল্প অগ্নিসংযোগ বা অসতর্কতায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এখানে প্রশ্ন জাগে-প্রশাসনের ভুমিকা কোথায়? গাজীপুর সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় পুলিশ-কোনো সংস্থাই এই বিপজ্জনক ব্যবসার দায়িত্ব নিচ্ছে না। একেকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা একেকভাবে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। সমবায় কমপ্লেক্সের মতো জায়গায় রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যবসা চলতে থাকলে, প্রশাসনিক নির্দেশনাও কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় এখন প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগের। সরকারের তৈরি আধুনিক গুদামগুলোতে ব্যবসায়ীদের স্থানান্তর বাধ্যতামূলক করতে হবে। টঙ্গীর আবাসিক এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে অবিলম্বে রাসায়নিক ব্যবসা উচ্ছেদ করতে হবে। পাশাপাশি গুদামের লাইসেন্স ও মনিটরিং প্রক্রিয়া কেবল কাগজে নয়, মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যদিকে, ব্যবসায়ীরাও দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। স্বল্প খরচ বাঁচাতে অবৈধভাবে আবাসিক এলাকায় গুদাম বসিয়ে তাঁরা লাখো মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। মুনাফার লোভে এমন বিপজ্জনক ব্যবসা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাসায়নিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ শুধু একটি শহরের নিরাপত্তার বিষয় নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সরকারের অর্থ বিনিয়োগে নির্মিত নিরাপদ গুদাম ফাঁকা পড়ে থাকা আর টঙ্গীজুড়ে মৃত্যুঝুঁকি বহন করে চলা-এ দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য আমাদের প্রশাসনিক অক্ষমতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। এখনই কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, প্রতিটি অগ্নিকা-ই কেবল প্রাণহানি বাড়াবে, কিন্তু শিক্ষা দেবে না।