রূপপুরে বিদেশি শ্রমিকের মৃত্যু: নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি ভাবনার সময় এখনই

পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের ধারাবাহিক মৃত্যু উদ্বেগজনক। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, গত চার বছরে রাশিয়ানসহ ২২ জন বিদেশি নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে, যার দুই-তৃতীয়াংশের কারণ হার্ট অ্যাটাক। বাকি মৃত্যুগুলো আত্মহত্যা, নিউমোনিয়া, স্ট্রোক ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে। ২০১৯ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন বিদেশি কর্মী মারা গেছেন-যা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং গভীরভাবে ভাবার বিষয়। ফরেনসিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিদেশি নাগরিকদের মৃত্যুতে পরিবেশ, আবহাওয়া ও খাদ্যাভ্যাস বড় ভূমিকা রাখছে। রাশিয়ার মতো শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে প্রচ- গরম ও আর্দ্র পরিবেশে কাজ করায় তাঁদের শরীর সহজে মানিয়ে নিতে পারছে না। সঙ্গে আছে খাদ্যাভ্যাসের পার্থক্য। বিশেষত উচ্চ তাপমাত্রা, শ্রমঘন কাজ ও মানসিক চাপ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তবে শুধু প্রাকৃতিক বা স্বাস্থ্যগত কারণেই কি এই মৃত্যুগুলো ঘটছে? প্রশ্ন উঠছে কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্যসেবা ও মানসিক সহায়তার প্রাপ্যতা নিয়েও। এত বড় একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পে স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা কার্যকর-তা খতিয়ে দেখা জরুরি। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য সাংস্কৃতিক অভিযোজনমূলক কার্যক্রম-এসব উদ্যোগ কি পর্যাপ্তভাবে নেওয়া হচ্ছে? আরেকটি দিক হলো দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যার ঘটনা। কয়েকজন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, কেউ সিঁড়ি থেকে পড়ে বা হোঁচট খেয়ে মারা গেছেন। এসব ঘটনা শ্রমিকদের মানসিক চাপ ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়। এ ধরনের সংবেদনশীল প্রকল্পে শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার বিষয়টি অবহেলা করা হলে ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে। এখানে রাষ্ট্রের ভাবনার জায়গা দুটি। প্রথমত, মানবিক দিক থেকে-বিদেশি নাগরিকেরা আমাদের দেশে এসে কাজ করছেন; তাঁদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, কৌশলগত দিক থেকে-রূপপুর প্রকল্প বাংলাদেশের জ্বালানি ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিদেশি শ্রমিকদের মৃত্যু প্রকল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে, আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন তুলতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন-একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে এই মৃত্যুগুলোর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা। পাশাপাশি শ্রমিকদের জন্য আধুনিক মেডিকেল সাপোর্ট সিস্টেম, তাপমাত্রা ও কর্মঘণ্টা নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা ছাড়া বিকল্প নেই। রূপপুর কেবল একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার প্রতীক। তাই এখানকার প্রতিটি শ্রমিকের জীবন সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্র ও প্রকল্প কর্তৃপক্ষের নৈতিক ও কৌশলগত দায়িত্ব।
