সম্পাদকীয়

আদায়প্রক্রিয়া শক্তিশালী করুন

ঋণখেলাপির ভয়াবহ বিস্তার

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত, যার মূল কারণ ঋণখেলাপির নজিরবিহীন বৃদ্ধি। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে এই ঋণের পরিমাণ বেড়েছে চার লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো, তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা- যা অর্থনীতির জন্য এক ভয়াবহ বার্তা। এই ঋণখেলাপির বিস্তার ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটকে তীব্রতর করেছে। ফলে নতুন ঋণ বিতরণে তারা অক্ষম হয়ে পড়ছে, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ করছে। আমানতকারীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, আর ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় ঋণ না পেয়ে সংকটে পড়ছেন। উচ্চ সুদের হারও তাদের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় রাজস্ব আদায়ে, অর্থনীতি হারাচ্ছে গতি ও স্থিতিশীলতা। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এক বছরে তা তিন গুণে পৌঁছেছে, যা স্পষ্টতই পূর্ববর্তী সরকারের সময়কার ঋণ বিতরণে অনিয়ম ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে তিনটি প্রধান কারণ- গোপন ঋণ প্রকাশ, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী খেলাপি ঘোষণার সময়সীমা কমানো, এবং কৃষি ও এসএমই ঋণে বিশেষ ছাড় বাতিল। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, অনেক চালু ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, যাদের ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। আগে আদালতের সুবিধা নিয়ে অনেক গ্রাহক খেলাপি ঋণকেও নিয়মিত দেখাতেন, সেই পথও এখন বন্ধ। আইএমএফের ঋণ শর্তও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির একটি বড় কারণ। তার মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো ঋণ আদায় প্রক্রিয়া জোরদার করা। এই পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন ঋণ আদায়ের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণখেলাপির অপসংস্কৃতি বন্ধ না হলে অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, যা দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষায় এখনই সময় সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোরতা, নীতিগত সংস্কার এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে- যাতে অর্থনীতি ফিরে পায় তার কাক্সিক্ষত গতি ও স্থায়িত্ব।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button