সম্পাদকীয়

রাজস্ব ঘাটতি ও কর-জিডিপি সংকট: সমাধানের পথ কোথায়?

বাংলাদেশের রাজস্ব কাঠামো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ রয়েছে। এবার সেই উদ্বেগ আরও প্রকট হয়েছে কর-জিডিপি অনুপাত কমে যাওয়ায়। ২০২০ সালে এই অনুপাত যেখানে ছিল ৭ শতাংশ, তা ২০২৫ সালে নেমে এসেছে ৬.৬ শতাংশে। অথচ আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী তা বাড়ানোর কথা। রাজস্ব আদায়ে এ ধরনের ব্যর্থতা কেবল বাজেট ঘাটতিই বাড়ায় না, আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক সংকেত পাঠায়। এনবিআরের লক্ষ্য সব সময় উচ্চাভিলাষী। চলতি অর্থবছরে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের টার্গেট নির্ধারণ করা হলেও প্রথম দুই মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা এই ব্যর্থতার মূল কারণ। রাজস্ব আয় বাড়াতে কেবল বাড়তি কর বা শুল্ক আরোপ যথেষ্ট নয়। বরং এতে ব্যবসায়ীদের উপর চাপ বেড়ে অর্থনীতি আরও শ্লথ হয়ে যেতে পারে। অর্থনীতিবিদদের মতে, মূলত কর-জিডিপি অনুপাতের স্থবিরতা একটি কাঠামোগত সমস্যা। বাংলাদেশে করজালের আওতা তুলনামূলকভাবে সীমিত, কর প্রশাসনে জটিলতা ও দুর্নীতি আছে, মামলা জট কমছে না, আবার করদাতাদের আস্থাও দুর্বল। ফলে যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইএমএফের সঙ্গে চলমান আলোচনায় বাংলাদেশের উচিত কেবল অজুহাত তুলে ধরা নয়; বরং সুস্পষ্ট রূপরেখা দেওয়া। আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, কর ফাঁকি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা, বকেয়া কর আদায়, এবং করদাতাদের জন্য ব্যবসা সহজীকরণ নীতি গ্রহণ-এসবের বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে হবে। কর সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি, কারণ দীর্ঘদিন ধরে কর ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক দুর্বলতায় জর্জরিত। রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ যেমন জরুরি, তেমনি দরকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল। কেবল আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের শর্ত পূরণ করলেই হবে না; বরং একটি স্থিতিশীল ও আস্থাশীল করব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নাগরিকরা মনে করবেন-কর দেওয়া মানে তাঁদের টাকার স্বচ্ছ ও ফলপ্রসূ ব্যবহার। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিনিয়োগ ও ব্যবসায় আস্থা না ফিরলে রাজস্ব আয় বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। তাই রাজস্ব কৌশলের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের সংস্কার সমানভাবে জরুরি। অন্যথায় কর-জিডিপি অনুপাতের এই নি¤œমুখিতা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button