সম্পাদকীয়

সড়কে মৃত্যু: নীতির ব্যর্থতা নাকি প্রয়োগের অদক্ষতা?

সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে ৪৪৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪১৭ জনের মৃত্যু-এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যার নয়, এটি একটি জাতির দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার প্রতিচ্ছবি। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিল, সড়কে নেমে পড়া মানে এখনও জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। একই সময়ে নৌপথে ২১ জন এবং রেলপথে ২৭ জনের প্রাণহানি-পরিবহন খাতের সামগ্রিক নিরাপত্তা-সংকটকেই প্রতিফলিত করে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মোট নিহতদের এক-তৃতীয়াংশ মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী। তরুণদের মধ্যে দ্রুতগামী যান চালানোর প্রবণতা, হেলমেট ব্যবহার না করা ও ট্রাফিক আইন অমান্যের সংস্কৃতি এই মৃত্যুর মিছিলে বড় ভূমিকা রাখছে। একইভাবে, পথচারীদের সচেতনতার ঘাটতি এবং শহর ও গ্রামীণ সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারানো যানবাহনের আধিক্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত ১১টি কারণ-ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, অদক্ষ চালক, অনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, চাঁদাবাজি, বিআরটিএর দুর্বলতা, ট্রাফিক ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা-সবই পুরনো সমস্যা, যেগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা হলেও বাস্তব পদক্ষেপ খুবই সীমিত। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের গড়িমসি, বিশেষত শাস্তির প্রয়োগে দুর্বলতা, দুর্ঘটনা রোধে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে আছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা শুধু যানজট বা জনঘনত্বের কারণে নয়; বরং অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন। মহাসড়কে ভারী ও স্বল্পগতির যান একসাথে চলা, সার্ভিস রোডের অনুপস্থিতি এবং অপ্রতুল ট্রাফিক পুলিশ পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে। এই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে “দোষী খুঁজে বের করলেই দায়িত্ব শেষ”-এই মনোভাব থেকে বের হতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে দীর্ঘমেয়াদি ও কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। দক্ষ চালক তৈরিতে প্রশিক্ষণকেন্দ্র বাড়াতে হবে, যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেটে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, এবং পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির অবসান ঘটাতে হবে। একই সঙ্গে, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং বিকল্প পরিবহন-রেল ও নৌপথের উন্নয়ন-জাতীয় অগ্রাধিকার হতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি জাতীয় অর্থনীতি ও উৎপাদনশীলতার ওপরও ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। প্রতিটি প্রাণহানিই আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। সময় এসেছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার সমন্বয়ে সড়ক নিরাপত্তাকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করার। নইলে পরিসংখ্যান বাড়তেই থাকবে, আর আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠব মৃত্যুর সংখ্যার প্রতি-যা কোনো সভ্য সমাজের কাম্য নয়।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button