আইনের বাইরে টোল আদায়: প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার প্রতিচ্ছবি

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক অঙ্গ। কিন্তু সেই আইনই যখন বিভিন্ন দপ্তরের ব্যাখ্যা-বিভ্রাটে উপেক্ষিত হয়, তখন নাগরিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলাও প্রশ্নের মুখে পড়ে। নরসিংদী পৌরসভায় সাম্প্রতিক টোল আদায়-সংক্রান্ত ঘটনাটি তার স্পষ্ট উদাহরণ। ২০২২ সালের হাইকোর্টের রিট পিটিশন (নং ৪৬৪০/২০২২)-এর রায়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়-টার্মিনাল ব্যতিরেকে কোনো সড়ক বা মহাসড়ক থেকে টোল বা পার্কিং ফি আদায় করা যাবে না। এই আদেশের ভিত্তিতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগ পৃথকভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে নির্দেশ দেয়, যেন আদালতের আদেশ কঠোরভাবে মানা হয়। পৌর আইনেও বলা আছে, পৌরসভা নিজস্ব টার্মিনাল ছাড়া অন্য কোথাও পার্কিং ফি আদায় অবৈধ। তবু নরসিংদী পৌরসভার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। পৌর টার্মিনাল না থাকা সত্ত্বেও অস্থায়ী ইজারা দিয়ে সড়কের ওপর থেকে টোল আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ইজারাদাররা সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা দিয়ে ‘বৈধতা’ দাবি করলেও আইন ও আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে স্পষ্টতই। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশ যখন হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়, তখন তা সংঘর্ষ ও চাঁদাবাজির মামলায় রূপ নেয়-যা প্রশাসনিক সমন্বয়ের ভয়াবহ ঘাটতি নির্দেশ করে। পুলিশের অবস্থান স্পষ্ট: আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করে মহাসড়কে টোল আদায় বেআইনি। অন্যদিকে পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, স্থানীয় সরকারের অনুমোদন অনুসারে রাজস্ব আদায় বৈধ। দুই পক্ষের এই অবস্থানগত বিভ্রান্তি আইনের প্রয়োগে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে এবং প্রশাসনের বিশ^াসযোগ্যতাকে ক্ষুণœ করছে। এ ঘটনায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে-কোনো প্রশাসক বা স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা কি আদালতের আদেশ অগ্রাহ্য করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? যদি না পারেন, তবে এই ইজারা বিজ্ঞপ্তি কীভাবে জারি হলো, তার দায় কার? প্রশাসনের একাধিক স্তরে এই দায়সীমা নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব রয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বল্প সময়ে শতাধিক আর্থিক লেনদেন ও নির্দেশনা স্বাক্ষর প্রশাসনিক সততার প্রশ্ন তোলে। স্থানীয় সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর প্রয়াস প্রশংসনীয়, কিন্তু তা কখনোই আদালতের নির্দেশনা ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে হতে পারে না। আইনের বাইরে রাজস্ব সংগ্রহ শুধু অনৈতিক নয়, তা জনবিশ^াস নষ্ট করে, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা বাড়ায়। এখন সময় আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কঠোরতা ও প্রশাসনিক সমন্বয় জোরদার করার। স্থানীয় সরকার বিভাগকে অবশ্যই পরিষ্কার নির্দেশনা দিতে হবে-কোথায় টোল আদায় বৈধ, কোথায় নয়। আইনের ব্যাখ্যার সুযোগ রেখে প্রশাসন চললে, তার ফল হয় নৈরাজ্য। আর নরসিংদীর ঘটনাটি সেই নৈরাজ্যেরই সতর্ক সংকেত।
