সম্পাদকীয়

অক্সিজেন সেবায় বৈষম্য ও মানবিক চ্যালেঞ্জ

মেডিক্যাল অক্সিজেন-একটি জীবনরক্ষাকারী উপাদান, যা আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার অপরিহার্য অংশ। অথচ বিশে^র নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে এই মৌলিক চিকিৎসাসেবা আজও গভীর বৈষম্য ও ঘাটতির শিকার। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবি আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অক্সিজেন সামিট ২০২৫’-এ প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, এসব দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ তীব্র অসুস্থতা বা অস্ত্রোপচারের সময় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন চিকিৎসা পান না। এই পরিসংখ্যান কেবল এক স্বাস্থ্য সংকটের নয়, মানবিক বঞ্চনার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি। দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মাত্র ৮৯ মিলিয়ন পর্যাপ্ত অক্সিজেন সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এই ঘাটতি এইচআইভি/এইডস বা যক্ষ্মার চিকিৎসা ঘাটতির চেয়েও বেশি। বিশেষ করে সাব-সাহারান আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পরিস্থিতি সবচেয়ে উদ্বেগজনক। আমাদের এই অঞ্চলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ। এটি বৈশি^ক স্বাস্থ্য সমতার ধারণায় এক বড় ধাক্কা। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ মহামারি অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, শুধু জরুরি পরিস্থিতিতে নয়, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবেও অক্সিজেনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। সামিটে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অক্সিজেনকে বিলাসী পণ্য নয়, বরং মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অক্সিজেন ঘাটতির মূল কারণ কাঠামোগত দুর্বলতা-উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, সরবরাহ ব্যবস্থার অদক্ষতা, পর্যাপ্ত সিলিন্ডার ও পাইপলাইন না থাকা, এবং অব্যবস্থাপনা। ইউনিসেফ, ইউএনওপিএসসহ বিভিন্ন সংস্থা দেশে অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন ও সরবরাহব্যবস্থা শক্তিশালী করতে কাজ করলেও টেকসই সমাধান এখনো অধরা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ এই সংকট মোকাবেলায় কার্যকর হতে পারে। বিশ^ব্যাংক ও এডিবির প্রতিনিধিরা যেমন বলেছেন, স্বল্পমূল্যে উৎপাদন ও স্থানীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা শক্তিশালী করা সম্ভব। বাবল সিপ্যাপের মতো সাশ্রয়ী উদ্ভাবন-যা মাত্র দুই ডলারে তৈরি করা যায়-দেখিয়েছে, স্থানীয় উদ্যোগও বৈশি^ক সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে। স্বাস্থ্যসেবায় সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে অক্সিজেনকে অগ্রাধিকারভিত্তিক নীতিতে স্থান দিতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি হাসপাতাল পর্যায়ে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়নও প্রয়োজন। একটি ন্যায্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখনই গড়ে উঠবে, যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন রোগীও শহরের নাগরিকের মতোই সময়মতো অক্সিজেন পাবে। জীবন রক্ষার মৌলিক উপকরণে বৈষম্য কোনো সমাজের মর্যাদা বাড়ায় না; বরং মানবতার পরিমাপকে ক্ষুণœ করে। তাই এখনই প্রয়োজন অক্সিজেন নিরাপত্তাকে জাতীয় অগ্রাধিকার ঘোষণা করে বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button