সম্পাদকীয়

অ্যানথ্রাক্স: গ্রামীণ স্বাস্থ্য ও সচেতনতার ঘাটতির সতর্ক সংকেত

দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আবারও অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ জনস্বাস্থ্যে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। রংপুর বিভাগে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ২৭ জন রোগী, আর মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় চলতি বছরের নয় মাসেই আক্রান্তের সংখ্যা ৪৭৫। যদিও সাম্প্রতিক সপ্তাহে নতুন সংক্রমণের খবর কমেছে, তবু আতঙ্ক এখনো রয়ে গেছে গ্রামাঞ্চলে। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ঘটনা যেন এক শিক্ষণীয় উদাহরণ। একটি অসুস্থ গরু জবাই করে মাংস ভাগাভাগি করার পর ১১ জনের শরীরে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা দেয়। এই এক ঘটনায়ই স্পষ্ট, সচেতনতার ঘাটতিই সংক্রমণ বিস্তারের প্রধান কারণ। অ্যানথ্রাক্স কোনো নতুন রোগ নয়- এটি ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, যা মূলত আক্রান্ত পশুর রক্ত, মাংস বা চামড়ার সংস্পর্শে এলে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। অথচ অনেক এলাকাতেই আজও সংক্রমিত পশু জবাই ও বিক্রির প্রচলন চলছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছে। আইইডিসিআর মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, নমুনা সংগ্রহ ও সচেতনতামূলক প্রচারও চলছে। কিন্তু মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও রংপুরের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব পদক্ষেপ এখনো যথেষ্ট নয়। গবাদি পশুর টিকাদান কাভারেজ সীমিত, প্রাণিসম্পদ বিভাগে জনবল ঘাটতি রয়েছে, এবং গ্রামীণ পর্যায়ে নিরাপদ মাংস ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা অত্যন্ত কম। অ্যানথ্রাক্সে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ব্যর্থ হলে তা বড় আকার ধারণ করতে পারে। তাই প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে প্রতিরোধই হতে হবে মূল কৌশল। আক্রান্ত এলাকায় অবিলম্বে গবাদি পশুর শতভাগ টিকাদান নিশ্চিত করা, সন্দেহজনক পশু জবাই নিষিদ্ধ করা এবং স্থানীয় মাংস বিক্রেতাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে তথ্যপ্রবাহ ও গণসচেতনতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য যেমন আতঙ্ক বাড়ায়, তেমনি সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগের দ্রুত ও স্বচ্ছ তথ্যদানের অভাবও ভীতি ছড়ায়। এ কারণেই সুন্দরগঞ্জে এক নারীর মৃত্যুকে ঘিরে গুজব ছড়িয়েছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের বিভ্রান্তি এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধ শুধু চিকিৎসা বা পশুচিকিৎসার বিষয় নয়-এটি একযোগে স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও তথ্যপ্রবাহ ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ। তাই এখন সময় হলো এই রোগটিকে মৌসুমি সমস্যা হিসেবে নয়, গ্রামীণ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার স্থায়ী অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার। জনসচেতনতা ও ভ্যাকসিনেশন-এই দুই অস্ত্রেই অ্যানথ্রাক্স নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন
Close
Back to top button