ক্রিকেটে আসছে নতুন ফরম্যাট টেস্ট-টোয়েন্টি

স্পোর্টস ডেস্ক : টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি-এই তিন সংস্করণের ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত বিশ^। এর মধ্যে কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ১০ ওভার ও ১০০ বলের ক্রিকেটও চালু হয়েছে। বলা যায় এগুলো টি-টোয়েন্টি সংস্করণেই অংশ। তবে আগামী বছর ক্রিকেটে যুক্ত হচ্ছে নতুন আরেক ফরম্যাট। যার নাম দেওয়া হয়েছে টেস্ট-টোয়েন্টি। সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ফরম্যাটের ঘোষণা দিয়েছেন ক্রীড়া উদ্যোক্তা ও ‘ওয়ান ওয়ান সিক্স নেটওয়ার্ক’-এর কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান গৌরব বাহিরওয়ানি। যুক্ত ছিলেন ম্যাথু হেইডেন, হরভজন সিং, ক্লাইভ লয়েড ও এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা। নামের মধ্যেই রয়েছে ইঙ্গিত-এই ফরম্যাট টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির সংমিশ্রণ। তবে ক্রিকেট প্রেমীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কীভাবে খেলা হবে এ ফরম্যাটে? কেনই বা এর নাম টেস্ট-টোয়েন্টি?
কীভাবে চলবে টেস্ট টোয়েন্টি?
এই ফরম্যাটে একটি ম্যাচে মোট ৮০ ওভার থাকবে-প্রতিটি দল খেলবে দুটি ইনিংসে ২০ ওভার করে। টেস্ট ম্যাচের মতোই প্রতিটি ইনিংসের স্কোর যোগ হবে মোট ফলে। অর্থাৎ, ম্যাচ শেষ হতে পারে জয়, পরাজয়, টাই বা ড্র-সবভাবেই। ড্র ঘোষণা করা হবে তখনই, যখন শেষ ইনিংসে ব্যাট করা দল শেষ বল পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি উইকেট হাতে রাখবে। তবে ম্যাচ ড্র হলে অনুষ্ঠিত হবে সুপার ওভারও।
প্রতিটি দল পাবে একবার ‘পাওয়ারপ্লে’ নেওয়ার সুযোগ। ক্যাপ্টেন চাইলে প্রথম ইনিংসেই নিতে পারেন, অথবা রেখে দিতে পারেন দ্বিতীয় ইনিংসের জন্য। চার ওভারের এই সময়টায় ৩০ গজের বৃত্তের বাইরে মাত্র দুই ফিল্ডার রাখা যাবে। আয়োজকদের দাবি, কখন পাওয়ারপ্লে নেওয়া হবে-এই সিদ্ধান্তটাই বাড়াবে কৌশল, শৃঙ্খলা আর ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতা।
আরেকটি নিয়ম-‘ফলো-অন’। টেস্টের মতোই প্রতিপক্ষ দল পিছিয়ে থাকলে এটি প্রয়োগ করা যাবে, তবে ব্যবধান হবে মাত্র ৭৫ রান (টেস্টে ২০০)। এ ছাড়া আছে নতুনত্ব-‘আর্লি কলাপ্স ক্লজ’। কোনো দল যদি প্রথম ইনিংসে প্রতিপক্ষকে ১০ ওভারের কমে অলআউট করে দিতে পারে, তাহলে তারা তাদের নিজস্ব ইনিংসে তিন ওভার অতিরিক্ত খেলতে পারবে।
প্রতিটি ম্যাচে সর্বোচ্চ পাঁচজন বোলার ব্যবহার করা যাবে। একজন বোলার সর্বোচ্চ ৮ ওভার করতে পারবেন, তবে তা দুই ইনিংসে ভাগ করে নিতে হবে-যেমন প্রথম ইনিংসে ৩ ওভার, দ্বিতীয়তে ৫ ওভার।
কোথায় হবে এই টুর্নামেন্ট?
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হবে প্রথম মৌসুম। জুনিয়র টেস্ট-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়নশিপ নামে শুরু হবে এটি। প্রথম মৌসুম হবে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠে গড়াবে। এটির আয়োজক থাকবে ভারত। দ্বিতীয় মৌসুম থেকে নারী ক্রিকেটারদেরও সুযোগ দেওয়া হবে।
প্রথম মৌসুমে অংশ নেবে মোট ছয়টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দল-দুবাই, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহর (এখনও নির্ধারিত হয়নি) এবং ভারতের তিনটি শহর থেকে। খেলোয়াড় নিবন্ধন শুরু হবে ১৬ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা (বাংলাদেশ সময়) থেকে। নির্বাচনের জন্য থাকবে এক অভিনব ব্যবস্থা-‘এআই ডিসকভারি ইঞ্জিন’, যার মাধ্যমে ১০০০ জনের প্রাথমিক তালিকা তৈরি হবে। সেখান থেকে ৩০০ জনের নাম যাবে ‘গ্লোবাল অকশন পুল’-এ, যেখান থেকে প্রতিটি দল গঠন করবে ১৬ সদস্যের স্কোয়াড-৮ জন ভারতীয় এবং ৮ জন বিদেশি খেলোয়াড়।
এখানে থাকবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন-এআই-নির্ভর স্কাউটিং, ব্যাট-বল সেন্সর, যা তরুণদের দক্ষতা অনুশীলন ও উন্নয়নে সহায়তা করবে। তরুণ ক্রিকেটারদের কথা মাথায় রেখে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির সংমিশ্রণে নতুন এই ফরম্যাট আনা হচ্ছে। এই ফরম্যাটে প্রতিটা ম্যাচ চলবে একদিন, প্রতিটা ম্যাচে থাকবে টি-টোয়েন্টির মতো লড়াই।
কারা আছেন এই উদ্যোগের পেছনে?
ক্রিকেটের এই সংস্করণ উদ্ভাবন করেছেন ওয়ান-ওয়ান সিক্স নেটওয়ার্কের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ক্রীড়া উদ্যোক্তা গৌরব বাহিরভানি। আগামী প্রজন্মের প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের খুঁজে বের করাই এর লক্ষ্য। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসকে বাহিরভানি বলেন, ‘এটি কেবল একটি নতুন লিগ নয়। ক্রিকেটের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে ভবিষ্যৎ গড়ার একটি প্রচেষ্টা এটা। আমরা চাই এ সংস্করণের মাধ্যমে প্রজন্মের ক্রিকেটারদের প্রতিভা সঠিকভাবে উদ্ঘাটন ও উদ্যাপন করা হোক।’
এই নতুন ফরম্যাটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্স। তিনি বলেন, “আমি সত্যিই বিশ^াস করি, ক্রিকেটের এই চতুর্থ ফরম্যাট খেলাটিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। টেস্ট টোয়েন্টি টেস্ট ক্রিকেটকে প্রতিস্থাপন নয়, বরং পুনরায় কল্পনা করার প্রচেষ্টা-পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এটি একসঙ্গে পুরস্কৃত করবে স্থিতি আর সৃজনশীলতাকে, ধৈর্য আর শক্তিকে-দুই জগতের সেরা মেলবন্ধন।”
পরামর্শক বোর্ডে আছেন আরও তিন কিংবদন্তি-স্যার ক্লাইভ লয়েড, ম্যাথিউ হেইডেন এবং হরভজন সিং। লয়েড বলেন, “আমি ক্রিকেটের প্রতিটি যুগ দেখেছি। খেলা সবসময় পরিবর্তন করেছে নিজেকে, কিন্তু এতটা ভাবনাসম্পন্নভাবে আগে কখনো নয়। টেস্ট টোয়েন্টি ফিরিয়ে আনছে ক্রিকেটের শিল্প ও ছন্দ, আর সঙ্গে রাখছে আধুনিক যুগের তেজ।”
টেস্ট-টোয়েন্টির নিয়ম কী?
নতুন এই ফরম্যাটে একদিনে হবে ৮০ ওভারের খেলা, তবে থাকবে চার ইনিংস-প্রতিটি দল ব্যাট করবে দুইবার করে, একেবারে টেস্টের মতো। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই ফরম্যাটে জয়, পরাজয়, ড্র বা টাই-সব ধরনের ফলই সম্ভব। লক্ষ্য একটাই, টেস্টের কৌশল ও গভীরতা ধরে রেখে টি-টোয়েন্টির গতিময়তা ও সম্প্রচার-সুলভ রূপ দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা।
সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী গৌরব বাহিরওয়ানি বলেন, ‘আমরা কেবল একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করছি না, বরং একটি নতুন ক্রিকেট ইকোসিস্টেম তৈরি করছি। যেমনভাবে যুক্তরাষ্ট্রে এনসিএএ বিশ^বিদ্যালয় বাস্কেটবলের মাধ্যমে নতুন প্রতিভা তুলে আনে, আমরা ক্রিকেটে ঠিক তেমন একটি বৈশি^ক প্ল্যাটফর্ম গড়তে চাই।’
এই উদ্যোগের পাশে দাঁড়িয়েছেন কিংবদন্তি অনেক ক্রিকেটার। স্যার ক্লাইভ লয়েড, ম্যাথু হেইডেন, এবি ডি ভিলিয়ার্স ও হরভজন সিং এই প্রকল্পের প্রশংসা করে জানিয়েছেন, এটি ভবিষ্যতের ক্রিকেটার গড়ে তোলায় বড় ভূমিকা রাখবে।
এবি ডি ভিলিয়ার্স বলেন, ‘এই ফরম্যাটে খেলোয়াড়রা নিজেদের স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে। এটা ভয়হীন ক্রিকেট হলেও, দুই ইনিংসে টিকে থাকার মানসিকতা শেখার সুযোগ দেবে।’অন্যদিকে ম্যাথু হেইডেন বলেন, ‘তরুণরাই ভবিষ্যৎ। তাই এমন একটা উদ্যোগে থাকতে পেরে আমি গর্বিত। একদিনে ৮০ ওভারের খেলা দুই দুনিয়ার সেরা দিকগুলোকে একত্রে নিয়ে আসছে-এটা দারুণ ব্যাপার।’