সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সংকট রোধে দ্রুত প্রত্যাবাসন জরুরি

২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রায় ১৩ লাখ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এরা প্রত্যেকেই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অত্যাচার, জাতিগত নিধন ও পরিকল্পিত সহিংসতার মুখে নিজেদের ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, আইসিজে-তে আইনি পদক্ষেপ ও নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে আছে। দীর্ঘস্থায়ী এই অচলাবস্থা বাংলাদেশের কূটনৈতিক কৌশল কেবল প্রচলিত কূটনীতি ও নরম শক্তির ওপর নির্ভর করার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
উল্লেখ্য, কয়েক দশক ধরে তারা মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পিত বৈষম্য, প্রান্তিকীকরণ এবং নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। দীর্ঘকাল ধরে রাখাইনে বসবাস করলেও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের একটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, বরং প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করেছে। ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে তাদের রাষ্ট্রহীন করা হয় এবং শিক্ষাগ্রহণ, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, চলাচলের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক দাতাদের তহবিল সংকোচনের মাঝে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় লড়াই করছে বাংলাদেশ। দশের সীমিত সম্পদ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের ওপর এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। মাদকপাচারসহ অপরাধমূলক কার্যকলাপের কারণে দেশের সামাজিক কাঠামোও হুমকির সম্মুখীন। এই অবস্থায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘকাল ধরে রাখা বাংলাদেশের জন্য কোনো টেকসই বিকল্প হতে পারে না। সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে ড. ইউনূস যে সাত দফা পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন, তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও সুচিন্তিত। এর মূল ফোকাস হলো মায়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করে সহিংসতা বন্ধ করা, রাখাইনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরি করা। একই সঙ্গে রাখাইনে আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা, রোহিঙ্গাদের সমাজের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে আস্থা তৈরি করা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এই সংকট মায়ানমারের সৃষ্টি, আর এর সমাধানও সেখানেই নিহিত। আন্তর্জাতিক অর্থায়ন যখন ক্রমেই কমে আসছে এবং বিশ্বসম্প্রদায় যখন অন্যান্য সংকটে ক্রমে বেশি করে জড়িয়ে পড়ছে, তখন প্রত্যাবাসন শুরু করাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও মানবিক পথ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া এবং মায়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button