সম্পাদকীয়

নারী নেতৃত্বের চার দশক: অর্জন অনেক, কার্যকর অংশগ্রহণ কোথায়?

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে নারীর নেতৃত্ব কোনো নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষে নারী নেতৃত্ব ছিল বহু বছর। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে বিএনপির একজন সাধারণ কর্মী থেকে রাজনীতির নেতৃত্বে উঠে আসেন খালেদা জিয়া; যিনি আজ দলের চেয়ারপারসন। অপরদিকে ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের ছয় বছর পর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যু পরবর্তী সময়েও সংসদীয় বিরোধী দল হিসেবে রওশন এরশাদ নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেন। ইতিহাসে তাই নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি স্পষ্ট, শক্তিশালী এবং কখনো কখনো কেন্দ্রীয়ও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই দীর্ঘ চার দশকে নারীদের রাজনীতিতে কার্যকর অংশগ্রহণ কতটা নিশ্চিত হয়েছে? উত্তরটি আশাব্যঞ্জক নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতৃত্বে নারীর উপস্থিতি অনেক ক্ষেত্রে ‘প্রতীকী’, নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে নারীর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় খুব কম। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে নারীর অবস্থান থেকে শুরু করে মাঠরাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই বাধা হিসেবে রয়ে গেছে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, নিরাপত্তাহীনতা এবং সাংগঠনিক সংস্কৃতির ব্যত্যয়। বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানার মন্তব্যটিও গুরুত্বপূর্ণ-শুধু কোটা পূরণের মাধ্যমে নারীর রাজনীতি সমৃদ্ধ হয় না; প্রয়োজন সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ ও যোগ্যতার স্বীকৃতি। একই কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় এনসিপির মুখপাত্র সামান্তা শারমিনের কথায়-নারীদের শুধু দেখানোর জন্য নয়, দায়িত্ব ও ক্ষমতায়নের জন্য রাজনীতিতে আনতে হবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী দাবি করছে তাদের তৃণমূল পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে, তবে দেশজুড়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নারীর সংখ্যা আরও বাড়ানো জরুরি। তবুও বাস্তবতা হলো-মাঠে যখন টিকে থাকার রাজনীতি অস্ত্র, অর্থ, প্রভাব ও প্রতিনিয়ত অপমানের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পরিণত হয়, তখন নারীর সামনে সেই পথকে আকর্ষণীয় করে তোলে কোন শক্তি? গত বছরের আগস্ট-উত্তর পরিস্থিতিতে নারীদের পোশাক, পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ্য হেনস্তা দেখিয়েছে, নিরাপত্তার ঘাটতি আজো প্রকট। নারীদের শিক্ষায় আগ্রগতি, অর্থনৈতিক অবদান, পেশাগত সক্ষমতা-সব ক্ষেত্রেই উন্নতি দৃশ্যমান। কিন্তু নীতিনির্ধারণী রাজনীতি এখনও পুরুষশাসিত। শুধুমাত্র সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন দলীয় কাঠামোর ভেতরে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভূমিকা বৃদ্ধি; দরকার নিরাপদ রাজনৈতিক পরিবেশ, সংগঠনভিত্তিক নেতৃত্ব তৈরির সুযোগ এবং সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী নেতৃত্বের ইতিহাস যতই গৌরবময় হোক, বাস্তব পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন নারী কেবল প্রতীকী অবস্থান নয়, রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতিনির্ধারণ, আন্দোলন-সংগঠন এবং দলীয় কাঠামোর প্রতিটি স্তরে সক্রিয় ও প্রভাবশালী ভূমিকা রাখবেন। এখন প্রয়োজন দেখানো নেতৃত্ব নয়-কাজের নেতৃত্ব।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button