সম্পাদকীয়

পায়রা নদীর ভাঙন: প্রকৃতি নয়, অব্যবস্থাপনার প্রতিশোধ

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার পিঁপড়াখালী গ্রাম মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে। গত এক মাসে গ্রামটির ১০টি বসতবাড়ি, মসজিদ, কবরস্থান ও ফসলি জমি পায়রা নদীতে বিলীন হয়েছে। শুধু ঘরবাড়ি নয়, হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের শেকড়, স্মৃতি, ইতিহাস। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলো এখন আশ্রয়হীন, অনেকে বেড়িবাঁধের পাশে অস্থায়ী ঝুপড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই মর্মান্তিক চিত্র কেবল একটি গ্রামের নয়-পায়রা নদীতীরবর্তী প্রায় সব ইউনিয়নই আজ একই সংকটে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীভাঙনের পেছনে অন্যতম কারণ অব্যাহত বালু উত্তোলন। নদীর তলদেশ থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বালু তোলায় ¯্রােতের গতি ও প্রবাহের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, ফলে প্রতি বছর নতুন নতুন অংশে ভাঙন তীব্র হচ্ছে। পাউবোর পক্ষ থেকে ভাঙনরোধে পাঁচ হাজার জিও ব্যাগ ফেলার কথা বলা হলেও স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা বলছে, এসব পদক্ষেপ সাময়িক ও অপর্যাপ্ত। কার্যকর ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ ছাড়া স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। এ যেন প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, বরং মানুষের অব্যবস্থাপনার ফসল। বছরের পর বছর ধরে নদী ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনার অভাব, দুর্বল তদারকি এবং বালু ব্যবসায়ীদের প্রভাব মিলেই আজকের এই বিপর্যয়। দৈনিক প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, পিঁপড়াখালীর প্রবীণ বাসিন্দা মকবুল সিকদারের মতো অনেকেই জীবনে একাধিকবার বসতভিটা বদল করেছেন, পূর্বপুরুষের কবর হারিয়েছেন নদীতে। এই ব্যক্তিগত ক্ষতি আসলে জাতীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি-যেখানে একটি জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার দুর্বলতার কারণে বারবার বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ ও প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে জরিপ চলছে-এই আশ^াসে মানুষ বাঁচে না, বরং তলিয়ে যায় নদীর সঙ্গে। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে বালু উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করা এবং জরুরি ভিত্তিতে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে টেকসই বাঁধ নির্মাণ শুরু করা। পায়রা নদী দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি, কৃষি ও নৌপরিবহনের প্রাণ। এই নদী যদি এভাবে ক্ষয়ে যায়, তবে ক্ষতি শুধু ভূমির নয়-পুরো উপকূলীয় জীবনের ভারসাম্যও নষ্ট হবে। সরকারের উচিত এখনই একটি সমন্বিত নদীতীর সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা নেওয়া, যাতে ভাঙনরোধের পাশাপাশি জীবিকা, শিক্ষা ও পুনর্বাসনের বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায়। কারণ নদীভাঙন কেবল প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, এটি সামাজিক ও মানবিক সংকটও। পায়রা তীরের মানুষ আজ একটাই প্রশ্ন করছে-“আমাদের ঘর কি আবার ফিরবে?”সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, নইলে মানচিত্র থেকে শুধু গ্রাম নয়, বিলীন হবে মানুষের আশাও।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button