সম্পাদকীয়

পেঁয়াজে আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন-গরমিলের তথ্য ও শীতল নীতির বাস্তবতা

বাংলাদেশে পেঁয়াজ এখন শুধু রান্নার অপরিহার্য উপাদান নয়, এটি বাজার অস্থিরতার প্রতীকেও পরিণত হয়েছে। সরকারের নানা পরিকল্পনা ও ঘোষণার পরও দেশে এখনো পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রায় পাঁচ লাখ টনের ঘাটতি রয়ে গেছে। এর ফলেই প্রতিবছর পাঁচ থেকে সাত লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তবু বছরের একসময়ে বাজারে কেজিপ্রতি দাম শত টাকা ছাড়িয়ে যায়-যা ক্রেতাদের নাগালের বাইরে ঠেলে দেয় এ নিত্যপণ্যকে। তবে কৃষিবিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ বলছেন, এ ঘাটতি বাস্তবের চেয়ে কাগজে-কলমে বেশি। তাঁদের মতে, দেশে বর্তমানে আট থেকে দশ লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ আছে, এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে আরও চার-পাঁচ লাখ টন নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসবে। অর্থাৎ, বাস্তবে সরবরাহে সংকট নেই; বরং বাজার অস্থিরতার মূল কারণ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, সংরক্ষণব্যবস্থার দুর্বলতা ও তথ্যের অস্বচ্ছতা। এ অস্বচ্ছতার চিত্র সবচেয়ে স্পষ্ট সরকারি সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশে বছরে পেঁয়াজ উৎপাদন ২৯ লাখ টন, আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী তা ৪৪ লাখ টনেরও বেশি। একইভাবে বার্ষিক চাহিদার হিসাবেও মিল নেই-বিবিএসের হিসাবে ২৬ লাখ টন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে ৩৫ লাখ টন। এই গরমিলের ফলে বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাজার নিয়ন্ত্রণে দেখা দিচ্ছে গুরুতর সংকট। ২০১৯ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছিল ২০২৪ সালের মধ্যে পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পরিকল্পনা। সেই লক্ষ্য পূরণের কথা থাকলেও বাস্তবে অগ্রগতি খুবই সামান্য। মাঠপর্যায়ে উৎপাদন বাড়ানোর বদলে নীতিনির্ধারণী কৌশলেই থেকে গেছে নানা জটিলতা। কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজ সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, ফলে অতিরিক্ত পেঁয়াজ ফসল তোলার পর নষ্ট হয়ে যায়। আবার আমদানি নির্ভরতা বাড়ায় স্থানীয় বাজারে দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সময় সমন্বিত জাতীয় জরিপের মাধ্যমে পেঁয়াজের প্রকৃত উৎপাদন ও চাহিদা নির্ধারণ করার। পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে হিমাগার ও সংরক্ষণ সুবিধা বাড়ানো, আমদানি নীতিতে মৌসুমি নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং উৎপাদনমুখী গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কৃষিবিদ ড. মোহা. মাসুদুল হক যথার্থই বলেছেন, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেতে হলে ভারতনির্ভরতা কমাতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট মৌসুমভিত্তিক আমদানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে। প্রয়োজনে সরকারিভাবে মজুদ পেঁয়াজ বাজারে ছাড় দিয়ে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পেঁয়াজের সংকট তাই কেবল কৃষির নয়, এটি নীতি ও তথ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার প্রতিফলন। সঠিক তথ্য, সঠিক সময়ে সঠিক নীতি-এই তিনটি উপাদানই এখন দেশের পেঁয়াজ বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার মূল চাবিকাঠি।

সংশ্লিষ্ট সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button