‘শূন্য কর’-অর্থনীতির স্থবিরতার আয়না

দেশের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান ও শিল্প খাত-তিনটি ক্ষেত্রেই বর্তমানে গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ, উৎপাদন থমকে, বিনিয়োগ স্থবির-এসব মিলিয়ে অর্থনীতি যেন হাঁপাচ্ছে। এর সরাসরি প্রতিফলন এখন দেখা যাচ্ছে আয়কর রিটার্নের তথ্যে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব অনুযায়, চলতি অর্থবছরে বাধ্যতামূলক ই-রিটার্ন দাখিলকারীদের ৮৮ শতাংশই দিয়েছেন ‘শূন্য কর’। অর্থাৎ, তাঁরা কোনো কর দিতে পারেননি। এ এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। ১১ লাখের বেশি করদাতার মধ্যে ১০ লাখের বেশি শূন্য করদাতা থাকা নিঃসন্দেহে রাজস্ব ঘাটতির সংকেত। শিল্প খাতের ধস, বিশেষ করে পোশাক শিল্পে কারখানা বন্ধ হওয়া ও শ্রমিক ছাঁটাই-এ সংকটকে আরও গভীর করেছে। বিজিএমইএর তথ্যমতে, গত ১৪ মাসে ৩৫৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে কর্মহীন হয়েছেন এক লাখ ২০ হাজারের মতো শ্রমিক। এদের মধ্যে অনেকে আগে কর দিতেন, এখন আয়ের উৎস হারিয়ে তা দিতে পারছেন না। অর্থনীতির এই স্থবিরতা শুধু শ্রমজীবী মানুষকেই নয়, প্রভাব ফেলছে মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণিতেও। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, বিক্রির পতন ও মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকের আয় কমেছে। ফলে রাজস্ব আদায়ও পড়েছে চাপে। করদাতার সংখ্যা বাড়লেও রাজস্ব বাড়ছে না-এ এক কাঠামোগত দুর্বলতার ইঙ্গিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বিপুল সংখ্যক শূন্য করদাতা থাকা কেবল আয় কমে যাওয়ার ফল নয়; এটি তথ্য যাচাইয়ের দুর্বলতাকেও নির্দেশ করে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান যথার্থই উল্লেখ করেছেন-ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার ফলে অনেকেই রিটার্ন দিচ্ছেন, কিন্তু তাদের আয়ের প্রকৃততা যাচাই না করলে করফাঁকির ঝুঁকিও থেকে যায়। রাজস্ব ঘাটতির এ প্রবণতা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকার উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থ জোগাতে বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে, অথচ অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে এমন দুরবস্থা টেকসই নয়। কর প্রশাসনকে এখন আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও তথ্যনির্ভর হতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন কর্মসংস্থান ও শিল্প পুনরুজ্জীবনে বিশেষ উদ্যোগ-যাতে আয় বাড়ে, কর প্রদানে সক্ষমতা গড়ে ওঠে। ই-রিটার্ন ব্যবস্থায় করদাতারা সহজে কর দিতে পারছেন, কিন্তু প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, সার্ভার সমস্যা, তথ্য অসামঞ্জস্য ইত্যাদি কারণে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এসব ত্রুটি দ্রুত সমাধান না করলে কর সংস্কারের সুফল মাঠপর্যায়ে পৌঁছাবে না। অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনতে হলে শুধু কর নীতি নয়, সামগ্রিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে প্রাণ ফেরাতে হবে। কর্মসংস্থান, উৎপাদন ও আয়ের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত না হলে ‘শূন্য কর’-এর এই বাস্তবতা আরও প্রকট হবে-আর তা পুরো অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করবে।
