পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু-নেত্রকোনার ট্র্যাজেডি, দেশের জন্য সতর্কবার্তা

নদী, খাল, বিল, হাওর-জলভূমির বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশ। এই ভূপ্রকৃতি যেমন সৌন্দর্য ও সম্পদের উৎস, তেমনি প্রতি বর্ষায় তা হয়ে ওঠে মৃত্যুঝুঁকির নির্মম বাস্তবতা, বিশেষত শিশুদের জন্য। দৈনিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে থেকে জানা গেছে, শিশুমৃত্যুর এই ভয়াবহতা সবচেয়ে প্রকট নেত্রকোনায়, যেখানে মাত্র চার বছরে পানিতে ডুবে ৩০০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে-সংখ্যাটি শুধু আতঙ্কজনক নয়, শোকের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ব্যর্থতাকেও কড়া ভাষায় স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্ষায় জেলার ছয়টি উপজেলা পানিতে ডুবে থাকে। ফলে ঘরসংলগ্ন পুকুর, উঠানের পাশে জমে থাকা পানি কিংবা হাওরের নৌযান-সবই শিশুদের জন্য অদৃশ্য ফাঁদে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো রীতিমতো হৃদয়বিদারক। কানিয়ান গ্রামে দুই শিশুর একসঙ্গে ডুবে মৃত্যু, জালালপুরে তিন বছরের ইমরানের চলে যাওয়া, নল্লাপাড়া গ্রামের ছোট্ট সোয়াইবার মৃত্যু-এসব খবর একেকটি পরিবারের অপুরণীয় ক্ষতির পাশাপাশি প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যর্থতার নগ্ন সাক্ষ্য বহন করে। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮১ শিশু পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে; শুধু কলমাকান্দায় মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন মৃত্যুরোধে প্রশাসনের কার্যক্রম বহু বছর ধরেই কাগজে-কলমে বেশি, বাস্তবে কম। অভিভাবকদের অসচেতনতা একটি কারণ হলেও, তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি। জেলার সদ্য বিদায়ী প্রশাসক কয়েকটি উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন-নৌযানে লাইফ জ্যাকেট নিশ্চিত করা, সাঁতার শেখার একাডেমির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা এবং শিশু যতœকেন্দ্র প্রকল্প চালু থাকা। তবে এগুলো কার্যকরভাবে মাঠে বাস্তবায়িত না হলে পরিস্থিতির লেশমাত্র পরিবর্তন ঘটবে না। নদীমাতৃক দেশের নাগরিক হিসেবে সাঁতার জানা আমাদের মৌলিক জীবনদক্ষতা হওয়া উচিত। অথচ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাঁতার শেখানোর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। বিশেষত হাওরবেষ্টিত অঞ্চলে সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক করা, স্কুল পর্যায়ে সাঁতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা, স্থানীয় পুকুর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা-এসব উদ্যোগ বহু আগেই নেওয়া প্রয়োজন ছিল। অতএব এখন প্রয়োজন জরুরি সমন্বিত উদ্যোগ-প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের যৌথ দায়িত্ব পালন। জনসচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালানো, শিশুদের নজরদারি বাড়ানো, ঝুঁকিপূর্ণ জলাধারগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং সাঁতার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা-এসব পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা আবশ্যক। নেত্রকোনার শিশুদের মৃত্যু শুধু একটি জেলার সমস্যা নয়-এটি পুরো দেশের জন্য সতর্ক সংকেত। জলকে ভালোবাসার পাশাপাশি তার বিপদকে সম্মান করা শিখতে হবে। আর তা শেখাতেই রাষ্ট্রের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি।
